ঘূর্ণিঝড় মোখা
এক তুফানে সব এলোমেলো হয়ে গেল তাদের
১৪ তারিখে তো দুনিয়া ফানা করে দিছে। লন্ডভন্ড করে দিছে। অনেক পয়সাওয়ালা যারা বড় বড় বিল্ডিং বানাইছে, ঝড়ের সময় আমরা ওখানে ছিলাম। এখানে ১২-১৩ ঘণ্টা ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। দিনের ১০টায় ঝড় শুরু হয়েছে, রাত পর্যন্ত চলেছে। পরের দিন সকালবেলা তো ঘরবাড়ি চোখে দেখি না। ঘরবাড়ি উড়াই ফেলছে।
ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবের এই একটি অংশ পাওয়া যায় সেন্টমার্টিনের কবির আহাম্মদের কথায়। এই দ্বীপে এক সময় শুটকি মাছের ব্যবসা করতেন তিনি, এখন আর করেন না, বয়স হয়ে গেছে। মোখার আঘাত থেকে জীবন বাঁচাতে পরিবার নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
ঝড়ের তাণ্ডব কমার পর কবির ঘরে ফিরে দেখেন কিছুই আর আগের মতো নেই। ত্রিপলের ঘর তার উড়িয়ে নিয়ে গেছে মোখা।
কবির বলেন, আড়াই লাখ টাকা দিয়ে ঘর বাঁধছিলাম, সব উড়াই নিয়ে গেছে। এখন ছোট করে ঘর বানাইলেও তো টাকা লাগবে। আমার কাছে ১০-৫০ টাকাও নাই। পরিবারে আমিসহ ১১ জন থাকি। আমার দুই ছেলে আছে আর বাকি সব মেয়ে।
বিজ্ঞাপন
• আরও পড়ুন : ‘সেন্টমার্টিনের যেখানে যাবেন সেখানেই মোখার আঘাতের চিহ্ন’
ঘর তো নিয়ে গেল মোখা, এখন কী হবে? কবির বলছেন, আমি তো ঘর বান্ধানোর চিন্তা করি না। সেই চিন্তা খোদার কাছে। রিজিক তো আল্লায় দিবে। খাওন-দাওন কিছু নাই। মুড়ি-চুড়ি এসব খাইয়া চলতাছে। দোকানদারের থেকে ৫০০-১ হাজার টাকা বাজার বাকি করে নিয়ে যাব। ১৮-১৯ বছরের একটা পোলা আছে, সে সমুদ্রে মাছ মারে, ওইটাই দিয়েই চলে। আমি তো কাজ করতে পারি না।
‘আল্লাহই করছে এটা, শুকরিয়া, আলহামদুলিল্লাহ’
ভয়াবহ এই ঝড়ের সাক্ষী সেন্টমার্টিনের বহু মানুষ। তাদের একজন শামসুল হক, যিনি সেন্টমার্টিন দ্বীপে আমিন (জমি মাপার কাজ) হিসেবে কাজ করেন।
সেই ঝড়ের দিনের কথা বলতে গিয়ে শামসুল হক বলেন, যখন ঝড় আসে তখন দুপুর ১/২টা। ২টার সময়ও আমি বাড়ি। আড়াইটার সময় দমকা হাওয়া ওঠে। তখন বাড়ির ছেলে-মহিলারা সব পইরা গেছে। ঘরের চৌকাঠ ধরে আমি একজনই দাঁড়ায় ছিলাম। তখন আমার বিবি আইসা বলতেছে, তুমি আসো চইলা যাই। একটার পর একটা, একটার পর একটা, আরেক বাড়ির একটা আম গাছ ছিল ওটাও আমাদের উপর পড়ছে। কিন্তু মানুষের ক্ষতি হয় নাই, বাড়িঘরের ক্ষতি হয়েছে। বিরাট ক্ষতি হয়েছে আমার।
• আরও পড়ুন : ‘ত্রাণ হিসেবে’ ঘর নির্মাণ সামগ্রী চান সেন্টমার্টিনবাসী
গত রোববারের এই ঝড় শামসুল হককে ’৯১-এর ঝড়ের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের তুফানও এরকমই ছিল। তবে তখন এমন ক্ষতি হয়নি আমাদের। এখন বেশি ক্ষতি হয়েছে। আমার একটা বড় আম গাছ ছিল ঘরের দুয়ারে। ওইটা ভাইঙ্গা আমার বাড়ির উপর পড়ছে। আমার বাড়ি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
বাড়িতে আমার বউ, ছেলে, নাতিন এসব নিয়ে ৯ জন মানুষ আছে। আমার ঘর অনেক বড়, টঙের বাড়ি। এই বাড়ি নতুন করে বানাতে আবার ২-৪ লাখ টাকা লাগবে। কম হলেও ৪ লাখ টাকা লাগবে। টিন-কাঠের বাড়ি ছিল আমার। বাঁশের বেড়া দিয়েছিলাম দুই পড়ল দিয়ে। ওইটা বিল্ডিং-এর তুলনায় বহুগুণ শক্ত করে বানছিলাম। ৩৯ বছর হয়েছে আমার বাড়ির বয়স।
আল্লাহ নিয়েছে, আমি কি এটা ধরাধরি করে রাখব? সহায়-সম্বল যা ছিল সব শেষ। ধ্বংস হয়ে গেলাম। আল্লাহই করছে এটা, শুকরিয়া আলহামদুলিল্লাহ।
জীবন বাঁচলেও এই মানুষগুলোর ভয়াবহ আর্থিক ক্ষতি করে দিয়ে গেছে মোখা। ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারি সাহায্য প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, সরকার সাহায্য দিলে পামু। আমার তো ঘরটা এখন বানতে হবে। আমার ছেলেপেলে কম, মহিলা বেশি। একজন ছেলে তাও পাগল। আমি একজন লোক, পুরোটা সংসার আমার ইনকামে চলে। আমি সেন্টমার্টিন দ্বীপের আমিন, জায়গা-জমি মাপি। এই কাজ করে এক মাসের মধ্যে ৫-১০ হাজার টাকা পাইলে চলে যায় বাজার করতে। ওই রকম করে চলছে। এমনি তো ঘর বানানো সম্ভব না। আমার জন্য ভালো হইলো আমাদের টাকা দিয়া বাড়ি-ঘরটা বানায় দিক। বাড়িতে ঘর বানানো খুব দরকার।
‘এগুলো তো মাল দেওয়া না, কষ্ট দেওয়া’
সেন্টমার্টিনে মোখার মূল আঘাত ১৪ তারিখ দুপুরের দিকে শুরু হলেও ১১ তারিখ থেকেই কোস্টগার্ড, বিজিবির সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে দ্বীপের বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার কথা বলছিলেন। তবে শুরুতে নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হননি ট্রলারের মাঝি আবদুর শুক্কুর। তিনি বলেন, আমাদের মোটামুটি অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পশ্চিম দিকে যাইয়া বাড়িঘর ভাঙচুর কইরা গাছ অনেক ভেঙে গেছে। এখন আমরা টোকেন নিয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করছি। আমরা ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা।
• আরও পড়ুন : ট্রমায় ভুগছেন সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা
তিনি আরও বলেন, আমার কোনো কিছু হয়নি। ঝড়ের সময় আমি বাসায় ছিলাম। আমাদের আশপাশে বাড়িঘর ভাঙছে। কিন্তু আমার বাড়ির হালকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যেগুলো ভেঙেছে সেগুলো নতুন করে আবার বাঁধতে হবে। আর আমাদের যেগুলো ভেঙেছে সেগুলো মেরামত করতে হবে। আমাদের বাড়িঘর যেগুলো ভেঙেছে এগুলো মেরামত করতে গেলে ২০-২৫ হাজার টাকা লাগবে।
ত্রাণের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা শুনেছিলাম সরকারিভাবে অনেক কিছু দেওয়া হবে। কিন্তু আইসা দেখলাম এগুলা (ত্রাণ সামগ্রী) দিতাছে। এগুলো তো মাল দেওয়া না, কষ্ট দেওয়া। যে অবস্থা দেখলাম সিডরের টাইমে এত কষ্ট পাইনি। আমাদের এমপি সাব আইসা কিছু দিছিল। কিন্তু আমরা সেসব পাইনি। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের লোক আমরা, ঘাটে আসতে আসতে উনারা টাকা দিয়ে চলে গেছে।
এমএইচএন/এনএফ