স্বাস্থ্যের নিয়োগ জালিয়াতি : পরিচালকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা
হাসপাতালের টেকনোলজিস্ট, মেডিকেল টেকনিশিয়ান ও কার্ডিওগ্রাফারসহ আড়াই হাজার পদের নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে নিয়োগ কমিটির সভাপতি ও সাবেক পরিচালকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
মঙ্গলবার (২০ জুন) ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ সংস্থাটির উপপরিচালক মো. ফারুক হোসেন বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন।
বিজ্ঞাপন
দুদকের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মো. শফিউল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মামলায় আসামিরা হলেন- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগ সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি ও সাবেক পরিচালক মো. হাসান ইমাম, সদস্য সচিব আ খ ম আখতার হোসেন, খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মো. হারুনুর রশিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান মো. শাওকত আলী।
বিজ্ঞাপন
মামলার এজাহারে আসামিদের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে খাতা প্রণয়ন ও খাঁটি হিসেবে ব্যবহার এবং অফিসিয়ালি সরবরাহ করা উত্তরপত্র বর্তমানে থাকা উত্তরপত্র দ্বারা কোনো এক পর্যায়ে প্রতিস্থাপিত করার অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪০৯/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/৪৭৭(ক) ও ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এজাহার সূত্রে আরও জানা যায়, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে জরুরিভিত্তিতে বিভিন্ন হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এক হাজার ২০০টি, মেডিকেল টেকনিশিয়ান এক হাজার ৬৫০টি এবং কার্ডিওগ্রাফারসহ দুই হাজার ৭৯৮টি শূন্য পদে জনবল নিয়োগের ছাড়পত্র প্রদান করে সরকার। ২০২০ সালের ৩০ জুন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় তিনটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আবেদনের শেষ সময় ছিল ২০ জুলাই। বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে মোট ৭২ হাজার ৬১৫ প্রার্থী আবেদন করেন। লিখিত পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগ। নিয়োগ পরীক্ষার মধ্যে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদে ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর, মেডিকেল টেকনিশিয়ান (ইসিজি) পদে ওই বছরের ১৮ ডিসেম্বর, মেডিকেল টেকনিশিয়ান (এনেসথেসিয়া, ডায়ালাইসিস, কার্ডিওগ্রাফার, বায়োমেডিকেল, ইটিটি, পারফিউশনিস্ট, সিমুলেটর, অর্থোপেডিক্স, ইকো) পদে ১৯ ডিসেম্বর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষা শেষে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কেন্দ্র থেকে খাতা বুঝে নেন। নিয়মানুযায়ী নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক আ খ ম আক্তার হোসেনের নিকট তা জমা হয়। এরপর মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও মেডিকেল টেকনিশিয়ান (ইসিজি) সংশ্লিষ্ট খাতা মূল্যায়নের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান মো. শাওকত আলীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
অন্যদিকে মেডিকেল টেকনিশিয়ান (অন্যান্য) পদের লিখিত খাতা মূল্যায়নের জন্য খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মো. হারুনুর রশিদের কাছে জমা দেওয়া হয়। লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর রাতে কতিপয় সিন্ডিকেট চক্র পুনরায় নতুন খাতায় প্রশ্নের উত্তর লিখে প্রতিস্থাপন করেন। খাতার কাভার পেজে একাধিকবার স্ট্যাপলিং করা ছিদ্র কিন্তু মূল খাতায় একবার স্ট্যাপলিং এবং উত্তরপত্রের বিভিন্ন স্থানে পেন্সিলে লেখা অস্পষ্ট সংকেতের প্রমাণ মেলে।
উত্তীর্ণ চার হাজার ৪৫৩টি খাতা, টেবুলেশন শিট ও অন্যান্য উপকরণ পরীক্ষার পর দুই হাজার ৪১১টি উত্তরপত্রে একাধিক স্ট্যাপলিং করা ছিদ্র এবং পেন্সিলে লেখা বিভিন্ন ধরনের সংকেতের প্রমাণ পান দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা। এসব বিষয়ে চাকরিপ্রার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা কোনো সঠিক তথ্য দুদককে দিতে পারেননি। তবে জানা যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত বিভিন্ন অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে ক্ষেত্র বিশেষে ১৫-২০ লাখ টাকা নেওয়ার তথ্য মেলে।
দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষায় উচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত অধিকাংশ পরীক্ষার্থীর সরবরাহ করা উত্তরপত্র বর্তমান উত্তরপত্র দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে বলে অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া গেছে। নিয়োগ কমিটির সভাপতি মো. হাসান ইমাম লিথোকোড ফরমের ছেঁড়া অংশ ও সদস্য সচিব আ ফ ম আখতার হোসেন গোপনীয়ভাবে খাতা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। মো. হাসান ইমামের পিএ আহসান সাইদ, পিএ আবু সোহেল এবং এও কবির আহমেদ ও আক্তারুজ্জামান সোহেল নিয়োগ কমিটির সভাপতি ও সদস্য সচিবের সঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সরাসরি জড়িত ছিলেন। তারা অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িত কি না- সেজন্য আরও অনুসন্ধান প্রয়োজন মনে করছে দুদক।
অন্যদিকে খিলগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মো. হারুনুর রশিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষক মো. শাওকত আলী খাতাগুলো নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণের দিন সদস্য সচিব আ ফ ম আখতার হোসেনের কাছ থেকে গ্রহণ করেন। পরীক্ষার পরবর্তী রাত বা দিনে বিকল্প খাতায় নতুন করে প্রশ্নের উত্তর লিখে তা অফিসিয়ালি সরবরাহ করা খাতায় প্রতিস্থাপন করেন। এসব কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগ সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি মো. হাসান ইমাম, সদস্য সচিব আ খ ম আখতার হোসেন, খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মো. হারুনুর রশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান মো. শাওকত আলীর বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গ ও জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
যদিও নানা বিতর্কে নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রথমে স্থগিত এবং পরে বাতিল করা হয়। এরপর ঘুষ লেনদেনের ওই সিন্ডিকেটের মুখোশ উন্মোচনে মাঠে নামে দুদক।
আরএম/জেডএস