২০ শয্যার একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ডায়ালাইসিস সেন্টার থাকা সত্ত্বেও নতুনভাবে বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অসম চুক্তি করেছে রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ডায়ালাইসিস সেন্টারে প্রয়োজনীয় যন্ত্র ও শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করতে বিতর্কিত জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়। যা একটি অসম চুক্তি এবং শুভঙ্করের ফাঁকি। জেএমআইকে সুবিধা দিতে হাসপাতালের নিজস্ব মেশিন অকেজো রাখারও অভিযোগ রয়েছে।

‘হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, টিআইবির পরিচালক (গবেষণা ও পলিসি) মুহাম্মদ বদিউজ্জামান, পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন কনসালটেন্ট তাসলিমা আক্তার ও সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (গবেষণা ও পলিসি গবেষণা) মো. মাহ্ফুজুল হক।

গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, চুক্তিতে ২০টি মেশিন সরবরাহ করার কথা থাকলেও ১২টি মেশিনের মাধ্যমে চলছে হাসপাতালটির ডায়ালাইসিস সেন্টার। এর মধ্যে আটটি মেশিন জেএমআই কর্তৃক সরবরাহকৃত, বাকি চারটি হাসপাতালের নিজস্ব।

জেএমআইকে সুবিধা দিতে হাসপাতালের নিজস্ব মেশিন অকেজো রাখার অভিযোগ রয়েছে। চুক্তিতে ডায়ালাইজার সর্বোচ্চ চারবার ব্যবহারের উল্লেখ এবং প্রতিবার রোগী প্রতি টাকা আদায়ের পরিমাণ নির্ধারিত থাকলেও পুনর্ব্যবহারে জেএমআই কত টাকা পাবে তার উল্লেখ নেই।

এ কাজে জেএমআইয়ের প্রশাসনিক কোনো খরচ (সেন্টার প্রতিষ্ঠায় অগ্রিম বাড়ি ভাড়া, মাসিক ভাড়া, চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীর বেতন ইত্যাদি) না হলেও লাভের বড় অংশ গ্রহণ করছে। আবার ডায়ালাইজার সর্বোচ্চ চারবার ব্যবহার সম্পর্কে বলা থাকলেও একবার ব্যবহারের মাধ্যমে ডায়ালাইসিস সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এতে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের বেশি পরিমাণে অর্থ আয়ের সুযোগ তৈরির অভিযোগ রয়েছে।

উল্লেখ্য, জেএমআই কর্তৃক সরবরাহকৃত অ্যাক্সেসরিজ (ফ্লুইড, ব্লাড লাইন, কেনোলা, গ্লাভস) ব্যবহারে রোগী প্রতি ২,৬৫০ টাকার মধ্যে ১,৫০০ টাকা (৫৬.৬ শতাংশ) জেএমআই গ্রহণ করছে।

জেএমআইএর লভ্যাংশ প্রতি বছর চার শতাংশ হারে বাড়ানোর সুযোগ এবং ডায়ালাইসিস সেন্টারের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীর বেতন, মাসিক ভাড়া খরচ না হলেও লাভের বড় অংশ জেএমআইএর গ্রহণ করছে। ডায়ালাইসিস বিভাগ থেকে ব্যক্তিস্বার্থে রোগীকে বাইরের প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে।

দেড় কোটি থেকে ৫১ লাখে নেমেছে হাসপাতালের লাভ

হলি ফ্যামিলিতে হাসপাতাল ইউনিট প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখনো লাভ করতে না পারলেও প্রতি মাসে জেএমআইকে বিল দিয়েছে। ফলে এ খাত থেকে হাসপাতালের আয় ২০১৯ সালে প্রায় ১.৫ কোটি টাকা থেকে ২০২০ সালে প্রায় ৭১ লাখ, ২০২১ সালে প্রায় ৫১ লাখে এসে দাঁড়ায়।

ক্রয় ও সংস্কার

হাসপাতালের ক্রয়-প্রক্রিয়ায় নির্ধারিত পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। নির্দিষ্ট সীমা বা তিন লাখ টাকার বেশি ক্রয়ে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করে প্রাইস কোটেশন পদ্ধতি অনুসরণ, একই ব্যক্তি থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে প্রাইস কোটেশন সংগ্রহ ও পছন্দের ব্যক্তিকে কাজ প্রদান করা হয়েছে। তুলনামূলক প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান ও পণ্যের প্রযুক্তিগত ও আর্থিক মূল্যায়ন না করে একক বিক্রেতাকে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়েছে।

চিকিৎসা সরঞ্জাম যেমন– ওটি লাইট, ওটি টেবিল, ভেন্টিলেটর বাজার দামের চেয়ে বেশি দামে ক্রয় করা হয়েছে। নির্দিষ্ট দোকান থেকে ক্রয়ে কমিশন হিসেবে এসি, টিভি, ফ্রিজ, ওভেন, ওয়াশিং মেশিন নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা, ট্রেড লাইসেন্স, ট্যাক্স শনাক্তকরণ নম্বর, ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর সঠিকভাবে যাচাই না করে কাজের আদেশ প্রদান করা হয়েছে। বৃহৎ ক্রয়ে প্রতিযোগিতামূলক ও উন্মুক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। এসি, স্টিল, সিমেন্ট ও নির্মাণ সামগ্রী ক্রয় এবং ক্রয়সংক্রান্ত নথি যাচাইয়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে নথিতে উল্লিখিত ঠিকানায় না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিল প্রদানে কর এবং ভ্যাট না কেটে বিল প্রদান এবং সরকার রাজস্ব হারানোর অভিযোগ রয়েছে। নগদ অর্থ পরিশোধে নির্ধারিত সীমা (১০ হাজার টাকা) লঙ্ঘন করে প্রায় ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নগদ প্রদান করা হয়েছে। কার্যাদেশ অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন না করলেও সম্পূর্ণ বিল প্রদান, কার্যাদেশে উল্লিখিত টাকার অতিরিক্ত বিল প্রদানে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ না করা এবং এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নথি হাসপাতালে না থাকার নজির রয়েছে।

রোগীর পথ্য টেন্ডারেও কেনে না হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল

স্থানীয়ভাবে বাজার কমিটি গঠন করে ক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে এক্ষেত্রে অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কমিটির সবাই বাজারে না যাওয়ায় শুধু খাদ্য বিভাগের লোকদের দিয়ে বাজার করানো হয়। মুরগি, চাল, সবজি পরিমাণে কম ক্রয় করে ভাউচারে বেশি দেখানো হয় এবং বাজার মূল্য থেকে বেশি মূল্য দেখানো হয়। হাসপাতালের ক্যান্টিন বরাদ্দেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

হাসপাতালের প্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্যাদি যেমন– টোনার, খাতা, কলম, গ্লাভস, সুঁই, সূতা, বাল্ব, তোয়ালে, জুতা, টিস্যু, ব্যাগ, পর্দা ইত্যাদি ক্রয়ে বাজার মূল্য অপেক্ষা বেশি মূল্যে ক্রয় রসিদ প্রদান করা হয়েছে। অতিরিক্ত মূল্যে ক্রয় করা হলেও তা যাচাই করা হয় না। এছাড়া গাইনি ওয়ার্ড, কেবিন/সেমি-কেবিন, হাসপাতালের সামনের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণ, বহির্বিভাগের সোয়ারেজ লাইন মেরামতসহ বিধি সংস্কার এবং আধুনিকায়নের কাজে প্রকৃত খরচের চেয়ে অধিক খরচ দেখানোর অভিযোগ রয়েছে।

হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীর চিকিৎসায় সব ওষুধ না লাগা সত্ত্বেও কখনো কখনো বিল পরিশোধ করানো এবং ক্ষেত্রবিশেষে রোগীর ওষুধ চুরি হওয়ার ঘটনা ঘটে। হাসপাতালে সব সময় সব ধরনের ওষুধের সরবরাহ থাকে না। এ সুযোগে মেডিকেল প্রতিনিধিরা হাসপাতালের নার্স, ফার্মেসির লোক, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের একাংশের মধ্যস্থতায় সরাসরি ওষুধ বিক্রির অভিযোগ রয়েছে।

জেইউ/এসএসএইচ/