উত্তপ্ত রাজনীতিতে আরও এক পরীক্ষায় আউয়াল কমিশন
সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই হিসেবে আগামী নভেম্বর থেকে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরু হবে। আর জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেই মাঠের রাজনীতিতে ব্যাপক তৎপর হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।
এ তৎপরতার মধ্যেই আজ রোববার (৩০ জুলাই) চট্টগ্রাম-১০ আসনের নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশ নিতে যাচ্ছে কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এ সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচনও নির্বাচন কমিশন ভবন থেকে সরাসরি সিসি ক্যামেরায় নজর রাখবে সাংবিধানিক এ সংস্থাটি।
বিজ্ঞাপন
এদিকে, মাঠের রাজনীতির প্রধান দুই দল ক্ষমতাসী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে বোঝা যাচ্ছে উত্তপ্ত হচ্ছে মাঠের রাজনীতি। তবে রাজনৈতিক দলগুলো যতই তৎপর হোক না কেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে বলে সাফ জানিয়েছে বর্তমান কমিশন। সেই সঙ্গে বিদেশিরাও সংবিধান অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। এ ক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনে কে আসবে বা কে আসবে না সেটা কমিশনের ভাবার বিষয় নয় বলেই জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।
আরও পড়ুন : হঠাৎ কর্মসূচিতে রাজধানীতে রাজনৈতিক উত্তাপ
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, রাজনৈতিক ফয়সালা রাজনীতির মাঠেই করতে হবে। এক্ষেত্রে কমিশন কোন ভূমিকা রাখতে পারবে না।
সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদ ও কূটনৈতিকদের তৎপরতায় বাংলাদেশের আসন্ন সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষতার আভাস দিচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, রাশিয়া, ভারত, ইরান, জাপান, জার্মানি সবারই আগ্রহের কেন্দ্রতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। সবার চাওয়া আগামী নির্বাচন যেন অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়। এমনকি বর্তমান সরকারও বলছে, তারাও অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। ক্ষমতাসীনরা চায় সব দল আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি বেশ পুরনো এবং মাঠের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীনদের প্রধান বিরোধী দল। এই দলটি গতবার একাদশ জাতীয় সংসদে সেভাবে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনি। এমন অবস্থায় যদি বিএনপি আবারও নির্বাচন বর্জন করে, তাহলে কি পরবর্তী সময়ে নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ার শঙ্কা থাকবে? এমন প্রশ্নই বিভিন্ন মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে। এজন্য নির্বাচন নিয়ে দলটিকে এখনই ভাবতে হবে। তবে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে না থাকলেও সিটি, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলটির নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করেছেন। সর্বশেষ পাঁচ সিটিতে বিএনপির দুইজন মেয়র প্রার্থী অংশ নিয়ে পরাজিত হন। কিন্তু কাউন্সিলর পদে ১১৯ জন অংশ নিয়ে ৩৬ জন কাউন্সিলর বিজয়ী হন।
এদিকে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে বাইরের দেশগুলোর আগ্রহ বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বর্তমানে এক লাখ ৪৭ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গত এক দশকের অর্থনৈতিক সাফল্যও বাংলাদেশের প্রতি অনেকের আগ্রহ বাড়িয়েছে। ফলে বাংলাদেশকে ঘিরে এখন আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর নানা মেরুকরণ চলছে।
আরও পড়ুন : চট্টগ্রাম-১০ আসনে উপ-নির্বাচন আজ, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কা
বাংলাদেশ সব দেশের আগ্রহের কারণ কেন হলো এমন প্রশ্নে অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটা আমাদের কারণে নয়, এটা আমাদের আশপাশের দেশগুলোর কারণে হয়েছে। বিদেশিদের কাছে আমাদের গুরুত্বটা বাংলাদেশের অজান্তে হয়ে গেছে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত আছে। যার কারণে আমাদের গুরুত্ব বিদেশিদের কাছে আকাশচুম্বি হয়েছে। এছাড়া, মার্কিনীরা নতুন আইন করেছে বার্মা অ্যাক্ট। সেই কারণেও আমাদের মর্যাদা আকাশচুম্বী হয়ে গেছে।’
মাঠের রাজনীতির প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ক্ষমতাসীনদের পদত্যাগের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়ে তৎপর হয়েছে। কিন্তু এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করা হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হলো এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে কি আদৌ আর নির্বাচন হবে? তবে আন্তর্জাতিক মহলের সবার মুখে নিরপেক্ষ নির্বাচনের বচন থাকলেও, কারও মুখেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বচন নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ জানান, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের বাইরের জিনিস নয়। কারণ, সংবিধানের অতীত অংশের অংশ হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যতবারই যেই সমস্ত দেশে এক্সটা অর্ডিনারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়, ততবারই কিন্তু ডপট্রিন অব নেসেসিটির কথা বলা হয়। ডপট্রিন অব নেসেসিটি সবকিছুর ঊর্ধ্বে। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিন্তু সংবিধানের বাইরে গিয়ে দুই বছর দেশ শাসন করে গেছেন। তার উপর ভিত্তি করেই নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই নির্বাচনটাও তো সংবিধান অনুযায়ী ছিল না। কারণ, আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসলে যে, সংবিধানের ব্যত্যয় করবে না এর কোন নিশ্চয়তা নেই।’
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছে এ দেশের নির্বাচন নিয়ে। তবে পাঁচ সিটি নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ও ফলাফল বর্তমান সরকারের সাফল্য হিসেবেই দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ছাড়াও জাপা, ইসলামী আন্দোলন ও জাকের পার্টির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নির্বাচনকে প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য করেছে।
এর আগে, মার্কিন উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আখতার গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না সে বিষয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করছি না। আমরা বাংলাদেশে নির্বাচনের পরিবেশের ওপরই গুরুত্ব দিচ্ছি। নির্বাচনে কারা অংশ নেবে, কি নেবে না, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। বহির্বিশ্বের বার্তা অনেকটাই স্পষ্ট এখানে। বাইরের শক্তি শুধু পর্যবেক্ষণ করবে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হচ্ছে কি না।
সর্বশেষ ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী অনুসন্ধানী দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে ইসির অতিরিক্ত সচিব বলেছিলেন, আমাদের এ পর্যন্ত ৯১১টি নির্বাচন হয়েছে। এই নির্বাচনগুলো তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে নির্বাচন পরিবেশ নিয়ে এখন পর্যন্ত সেটিসফাইড হলেও তারা আরও আলোচনা করবে। নির্বাচনকালীন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটে আনার বিষয় ইইউ এর প্রতিনিধি দল কোনো প্রকার আলোচনা করেনি। তারা প্রধানত নির্বাচনী প্রস্তুতিটা কী তা জানতে চেয়েছে।
এক নজরে পাঁচ সিটির ভোট
গাজীপুর সিটি ভোটে স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন পান ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট।। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লাহ খান পেয়েছিলেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৬ ভোট। গাজীপুরে মেয়র পদে বিএনপি প্রার্থী না থাকলেও কাউন্সিলর পদে ২৯ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে বিজয়ী হন ১৩ জন, পরাজিত ১৬ জন। এই ২৯ জনই বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন।
বরিশাল সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ পান ৮৭ হাজার ৮০৮ ভোট। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলন সৈয়দ ফয়জুল করিম পেয়েছিলেন ৩৪ হাজার ৩৪৫ ভোট। এ সিটিতে মোট ভোটার উপস্থিতি ৫১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এ সিটিতে মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী ছিল ১ জন। কাউন্সিলর পদে ১৮ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে বিজয়ী হন ৯ জন, পরাজিত ৯ জন। এই ১৮ জনকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
খুলনা সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক পেয়েছিলেন ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮২৫ ভোট। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলন প্রার্থী মো. আ. আউয়াল রহমান পান ৬০ হাজার ৬৪ ভোট। খুলনা সিটিতে মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী না থাকলেও কাউন্সিলর পদে ৮ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করে। তবে কেউই বিজয়ী হতে পারেননি। পরাজিত ৮ জন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন।
সিলেট সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোহাম্মদ আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী পেয়েছিলেন ১ লাখ ১৯ হাজার ৯৯১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. নজরুল ইসলাম পান ৫০ হাজার ৮৬২ ভোট। এ সিটিতে মেয়র পদে বিএনপি ১ জন প্রার্থী ছিলেন। কাউন্সিলর পদে ৩৮ জন অংশগ্রহণ করে। বিজয়ী হন ৮ জন, পরাজিত হন ৩০ জন। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন ৩৮ জন প্রার্থী।
রাজশাহী সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ. এইচ. এম. খাইরুজ্জামান লিটন পেয়েছিলেন ১ লাখ ৬০ হাজার ২৯০ ভোট। মুরশিদ আলম ১৩ হাজার ৪৮৩ ভোট। লতিফ আনোয়ার ১১ হাজার ৭১৩ ভোট। জাতীয় পার্টির সাইফুল ইসলাম ১০ হাজার ২৭২ ভোট। এই সিটি নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন মোট ভোটারের শতকরা ৫৬.২০ শতাংশ। মেয়র পদে বিএনপি প্রার্থী না থাকলেও কাউন্সিলর পদে ২৬ জন অংশগ্রহণ করে। বিজয়ী হন ৬ জন, পরাজিত ২০ জন। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন ১৬ জন প্রার্থী।
এসআর/এসকেডি