গ্রেনেড হামলার প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে আগস্টের সেই বিকেল
‘সুরঞ্জিত দা বলছিলেন আমি আর বাঁচব না রে’
২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে মোটরসাইকেলে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, পেছনে নুরনবী ভূইয়াঁ রাজু/ সংগৃহীত
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তখনকার ছাত্রলীগ নেতা বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা নুরনবী ভূইয়াঁ রাজু। গ্রেনেড হামলায় আহত সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে মোটরসাইকেলে করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন রাজু।
ঢাকা পোস্টকে তিনি জানিয়েছেন তার চোখের সামনে ঘটা সেদিনের সেই ভয়াবহ নৃশংসতার গল্প—
বিজ্ঞাপন
সেদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আমাদের প্রোগ্রাম ছিল, সে কারণে প্রায় দুপুর থেকে সকল লোক সমবেত হওয়ার চেষ্টা করছিল। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকল এমপিকে বলেছেন, মিছিল সহকারে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে যোগ দেওয়ার জন্য। আমাদের এলাকার এমপি ছিলেন সাবের হোসেন চৌধুরী। তার নেতৃত্বে সবুজবাগ, খিলগাঁও ও মতিঝিল থেকে বিশাল মিছিল নিয়ে আমরা সমাবেশস্থলে যাচ্ছিলাম। একপর্যায়ে স্টেডিয়ামের কাছাকাছি যাওয়ার পর যখন দেখলাম ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পুরো রাস্তা জ্যাম হয়ে গেছে, নেত্রীর গাড়ি ঢুকে গেছে। সেসময় চারপাশে লোক আর লোক। এসময় সাবের হোসেন চৌধুরী বললেন- রাজু, আমরা এখানে নয়, সচিবালয়ের পেছনে অবস্থান নেব।
মিছিল নিয়ে সেখানে অবস্থানের পর নেতাদের বক্তব্য শুনছিলাম। একপর্যায়ে বক্তব্যের শেষ মুহূর্তে প্রচণ্ড রকমের শব্দ হচ্ছিল, একের পর এক বিকট শব্দ। আমরা তখনও ভাবিনি যে এগুলো গ্রেনেড! আমাদের কানে তখন বিশাল বিশাল শব্দ আসছিল। কিন্তু তখন আমরা সাবের ভাইকে ঘিরে সবাই বসে আছি। ওখান থেকে কিছুক্ষণ পরপর মিছিল ধরছি— স্বৈরাচারী খালেদা জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে, জামায়াত সরকারের বিরুদ্ধে।
বিজ্ঞাপন
হঠাৎ সাবের হোসেন চৌধুরী চিৎকার করে বলে উঠলেন- আমার নেত্রীকে মেরে ফেলেছে, চলো চলো নেত্রীকে মেরে ফেলেছে!
হঠাৎ সাবের হোসেন চৌধুরী চিৎকার করে বলে উঠলেন- আমার নেত্রীকে মেরে ফেলেছে, চলো চলো নেত্রীকে মেরে ফেলেছে! এই কথা বলে উনি আমাদের মধ্যে থেকে দৌড় দিয়ে সামনে চলে গেলেন। তখন সবুজবাগ থানার সেক্রেটারি আলমগীর চৌধুরী বলছিলেন- রাজু, সাবের হোসেন চৌধুরীকে ঠেকাও। আমি তখন ভাইকে ধরে রাখতে চাইছিলাম।
কিন্তু সাবের ভাইয়ের এত শক্তি যে, উনি আমাকে পাত্তাই দিলেন না। উনি আমাকে এক ধাক্কায় ছুঁড়ে ফেললেন। উনি দৌড়ে গেলেন পার্টি অফিসের সামনে। আমরা সকলে ওনার পেছন পেছন দৌড় দিলাম। এসে দেখি, এক বীভৎস অবস্থা! সে কী অবস্থা! নিচে শত শত নেতা পড়ে আছে— কারো হাত নেই, কারো পা নেই, সে এক করুণ দৃশ্য।
অনেকের নিথর দেহ পড়ে আছে, অনেকের শরীরের অর্ধেক উড়ে গেছে। সে অবস্থায় আমরা চেষ্টা করছিলাম— জাতীয় নেতৃবৃন্দ কোথায় কোন অবস্থায় আছে তা দেখতে। তখন সাবের ভাই বললেন, জাতীয় নেতৃবৃন্দ সবাইকে তোলো। তখন কেউ হানিফ ভাইকে কেউ মায়া ভাইকে অনেকেই অনেক সিনিয়র কেন্দ্রীয় নেতাকে টেনে তোলেন। সবার গা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।
একপর্যায়ে দেখি— সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দাদা পার্টি অফিসের এক পাশে পড়ে আছে। সাবের হোসেন ভাই, আমিসহ আরও কিছু নেতা একসঙ্গে বলে উঠলাম— এই যে সুরঞ্জিত দা পড়ে আছে।
আমাদের পার্টি অফিসের পাশেই বাটার যে দোকান আছে ওখান বরাবর নিথরভাবে পড়ে ছিলেন দাদা, বললাম সবাই ধরাধরি করে ওনাকে উঠান। কিন্তু কোথায় কীভাবে নেব তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। তখন এক সাংবাদিক বললেন, আমি মোটরসাইকেলে করে ওনাকে নিতে পারব।
সুরঞ্জিত দা হালকা সুরে বলছেন, ‘আমি মনে হয় আর বাঁচব না রে’। তখন সাবের ভাই বলছিলেন— দাদা আপনার কিচ্ছু হবে না। আপনি ওঠেন, রাজু আপনাকে নিয়ে যাবে।
তখন আমরা জিজ্ঞেস করলাম, নিতে পারবেন? তিনি বললেন, অবশ্যই, আপনারা তুলে দিলেই আমি নিতে পারব। সুরঞ্জিত দা হালকা সুরে কথা বলছেন... তিনি বলছেন, ‘আমি মনে হয় আর বাঁচব না রে’। তখন সাবের ভাই বলছিলেন— দাদা আপনার কিচ্ছু হবে না। আপনি ওঠেন, রাজু আপনাকে নিয়ে যাবে।
তখন আমি সাংবাদিককে বললাম, আপনি কি গাড়ি চালাতে পারবেন? তিনি বললেন, আপনি ধরে রাখতে পারলে আমি চালাতে পারব। তখন আমি ওনাকে নিয়ে প্রথমে ঢাকা মেডিকেলে গেলাম। সেখানে কোনো জায়গা নেই, হাহাকার অবস্থা। সেখান থেকে নিয়ে গেলাম বাংলাদেশ মেডিকেল, সেখানেও কোনো জায়গা নেই। তারপর শমরিতা মেডিকেলে গেলাম। তখন শমরিতাতে আমাদের জেলার (ফেনীর) একটা লোক ছিল। তখন উনি আমাকে বললেন উপরে এমডির রুম খালি আছে। আমি বললাম, কারো সঙ্গে কথা বলার সুযোগ নাই, উনি হচ্ছেন জাতীয় নেতা, একাধিকবারের এমপি সুরঞ্জিত সেন। ওনাকে বাঁচাতে হবে।
তারা ফোন করে এমডির সঙ্গে কথা বলল, তারপর বলল উপরে একটা রুম আছে নিয়ে যান। তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বা বারোটা বাজে। দেখি ডাক্তারের ওখানে অসংখ্য রোগী। রাত দুইটা বা তিনটার দিকে বৌদি আসেন। তখন দাদার গলার স্বর্ণের চেইনসহ পকেটের মধ্যে যা যা জিনিস ছিল আমি তা বৌদিকে দিই।
কী এক দৃশ্য! চারপাশে ধোঁয়া, অন্ধকার, কয়েক হাজার জুতা এবং মানুষের অসংখ্য টাকা-পয়সা নিচে পড়ে ছিল।
আমি সেদিন ২১ শে আগস্টে পার্টি অফিসের সামনে থেকে সুরঞ্জিত স্যার ছাড়াও অসংখ্য লোককে ভ্যানে তুলে দিয়েছি। যাদের পা ছিল না, হাত ছিল না যারা পঙ্গুত্ববরণ করেছে। ২০ জনের বেশি লোককে ভ্যান গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছি। কী এক দৃশ্য! চারপাশে ধোঁয়া, অন্ধকার, কয়েক হাজার জুতা এবং মানুষের অসংখ্য টাকা-পয়সা নিচে পড়ে ছিল। আমি সেদিন দেখেছি— কেউই টাকার দিকে তাকায়নি, কেউ কোনো কিছুর দিকে তাকায়নি, শুধু বলছে বাঁচতে হবে, বাঁচাও! অনেকের জিহ্বা বেরিয়ে গেছে, অনেকের মগজ বের হয়ে গেছে।
এই বীভৎস কাহিনী বলে শেষ করা যাবে না। অসংখ্য লোকের শরীরে প্রিন্টার ঢুকেছে, অসংখ্য লোক আহত-নিহত হয়েছেন।
আমি শুধু আপনাদের কাছে বলব— আপনারা সাংবাদিকরা লেখনীর মাধ্যমে এই জিনিসগুলো তুলে ধরবেন। সেসময় অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়, অসংখ্য মানুষের হাত-পা ছিল না, পঙ্গু হয়ে যায় অনেক নারী-পুরুষ।
এমএসআই/এমজে/এফকে/জেএস