চিকিৎসার কথা বলে ‘ঘুরে বেড়াচ্ছেন’ এএসআই সন্তু
এএসআই সন্তু শীল/ ছবি : সংগৃহীত
চট্টগ্রামের নগরের এক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) ধাক্কা দিয়ে আলোচনায় আসা পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) সন্তু শীল এখন কাগজে-কলমে উধাও। তাকে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। চিকিৎসার কথা বলে আড়াই মাসেরও বেশি সময় ধরে কর্মস্থল বাগেরহাট জেলায় অনুপস্থিত রয়েছেন। যদিও এ সময়ে একাধিকবার তাকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে বলে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। এ সংক্রান্ত কয়েকটি ছবিও ঢাকা পোস্টের কাছে রয়েছে।
বাগেরহাট জেলায় যোগদানের আগে এএসআই সন্তু শীল প্রায় ৪ বছর শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বডিগার্ড ছিলেন। গত ২০ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানার পাথরঘাটা এলাকায় উপমন্ত্রী নওফেল নিজ সংসদীয় আসনে ঈদ সামগ্রী বিতরণ করতে গেলে ওসি জাহিদুল কবিরকে ধাক্কা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে এএসআই সন্তুর বিরুদ্ধে। এরপর তাকে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের বিশেষ শাখা (সিটিএসবি) থেকে খুলনা রেঞ্জে বদলি করা হয়।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন : ওসিকে শিক্ষা উপমন্ত্রীর বডি গার্ডের ধাক্কা, থানায় জিডি
পুলিশ সূত্র জানায়, সদর দপ্তরের নির্দেশে এএসআই সন্তু চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) থেকে প্রথমে খুলনা রেঞ্জে যোগদান করেন। রেঞ্জ কার্যালয় থেকে তাকে বাগেরহাট জেলা পুলিশে যোগদান করতে বলা হয়। এরপর জেলা পুলিশের নির্দেশে তিনি ফকিরহাট মডেল থানায় যোগ দেন। এরই মধ্যে পুলিশের বিভাগীয় অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে ওঠা ওসিকে ধাক্কা দেওয়ার অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়। এরপর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার নির্দেশ দেয় সিএমপি। ১১ জুন সিএমপি অফিসিয়ালি চিঠি দিয়ে বাগেরহাট জেলা পুলিশকে বিষয়টি জানায়। সিএমপির চিঠি পেয়ে ফকিরহাট থানা পুলিশ তাকে ১৪ জুন ছাড়পত্র দিয়ে জেলা পুলিশ লাইনসে যোগ দিতে বলে।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু নিজ হাতে সই দিয়ে ছাড়পত্র গ্রহণ করেও পরবর্তীতে পুলিশ লাইনসে যোগ দেননি এএসআই সন্তু। ১৫ জুন তিনি লিখিতভাবে আবেদন করে জানান, থানা থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার পর অসুস্থ হয়ে ফকিরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। হাসপাতালটির চিকিৎসকরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য খুলনা অথবা ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হতে বলেন। এরপর প্রায় ৮২ দিন পেরিয়ে গেলেও মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত তিনি আর বাগেরহাট জেলা পুলিশ লাইনসে যোগ দেননি। এছাড়া চিকিৎসার বিষয়ে কোনো কিছু জেলা পুলিশের কর্মকর্তাদের অবহিত করেননি।
আরও পড়ুন : ওসিকে ধাক্কা, শিক্ষা উপমন্ত্রীর সেই বডিগার্ড ক্লোজড
এ নিয়ে গত ৯ আগস্ট সন্তুর সর্বশেষ অবস্থান জানেন না বলে বাগেরহাট জেলা পুলিশ সুপার সিএমপি কমিশনারকে লিখিতভাবে জানান।
তবে চট্টগ্রাম নগর পুলিশে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, এএসআই সন্তু বাগেরহাট জেলা পুলিশকে অসুস্থতার কথা বললেও তাকে চট্টগ্রামে ঘুরতে দেখা গেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তিনি ফটোসেশনও করেছেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় তিনি দাওয়াতেও অংশ নিয়েছেন।
তারা আরও জানান, গত ১ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র আবদুস সবুর লিটনের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে দেখা যায় এএসআই সন্তু শীলকে। এছাড়া ২০ আগস্ট রাতে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী কানুনগোপাড়ায় একটি কুলখানিতে অংশ নিতে দেখা যায়।
এএসআই সন্তু শীলের বিষয়ে জানতে বাগেরহাট জেলা পুলিশ সুপার কে. এম. আরিফুল হককে মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর) ফোন করা হলে তিনি মিটিংয়ে আছেন জানিয়ে ফকিরহাট মডেল থানার ওসির সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
আরও পড়ুন : ওসিকে ধাক্কা দেওয়ার সত্যতা মিলেছে সন্তু শীলের বিরুদ্ধে
জানতে চাইলে ফকিরহাট মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মু. আলীমুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এএসআই সন্তু বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে আমরা অবহিত নয়। সিএমপির সাময়িক বরখাস্তের নির্দেশনা পেয়ে তাকে ১৪ জুন থানা থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। একদিন পর তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার কথা জানান। এরপর অফিসিয়ালি তার বিষয়ে কোনো কিছু জানা যায়নি। যতটুকু খবর পেয়েছি, তিনি ফকিরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। তবে চিকিৎসা শেষে তিনি আর পুলিশ লাইনসে যোগ দেননি। আমি এমনিতে তার সঙ্গে সেলফোনে কথা বলেছি। একপর্যায়ে তিনি পুলিশের আর চাকরি করবেন না বলে জানিয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এএসআই সন্তু শীল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি চিকিৎসা নিচ্ছি। এরপর যোগদান করব। এটি পুলিশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, নিউজের কী আছে? তবে আপনি চাইলে নিউজ করতেও পারেন।
পুলিশের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা উপমন্ত্রীর বডিগার্ড হিসেবে কোতোয়ালি থানার ওসিকে নানা বিষয়ে তদবির করতেন সন্তু। তবে ধাক্কা দেওয়ার ঘটনার কয়েক মাস আগে কোতোয়ালি থানার ওসি তাকে কোনো বিষয়ে তদবির করতে বারণ করেন। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন এএসআই সন্তু। এ কারণে শিক্ষা উপমন্ত্রীর সঙ্গে থাকার সময় তিনি কৌশলে ওসি জাহিদুল কবিরকে ধাক্কা দেন।
আরও পড়ুন : ওসিকে ধাক্কা, চট্টগ্রাম ছাড়তে হচ্ছে শিক্ষা উপমন্ত্রীর বডিগার্ডকে
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সন্তু শীলের এমন অসদাচরণ ওইবারই প্রথম নয়। এর আগেও তার বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানার সাবেক ওসি নেজাম উদ্দিন, পটিয়া থানার ওসি প্রিটন সরকার, বন্দর থানার সাবেক ওসি জাহিদুল কবিরের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ রয়েছে। ওসি নেজাম উদ্দিন তার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে জিডি করেছিলেন।
সবশেষ ২০ এপ্রিলের ঘটনায় নিজ থানায় জিডি করেন কোতোয়ালি থানার ওসি জাহিদুল কবির। পাশাপাশি তিনি সিএমপি পুলিশ কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। এ ঘটনার পর ২৫ এপ্রিল এক আদেশে তাকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়। একই দিন পৃথক আরেকটি আদেশে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার (এডিসি) আসিফ মহিউদ্দিনকে। তদন্তে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু হয়। গত ২ মে পুলিশ সদর দপ্তরের এক আদেশে তাকে প্রশাসনিক কারণে সিএমপি থেকে খুলনা রেঞ্জে বদলি করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম নগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রভাব খাটিয়ে এএসআই একের পর এক ঘটনা ঘটাতে থাকলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সবশেষ কোতোয়ালি থানার ঘটনায় আলোচনা-সমালোচনা হলে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। না হলে পুলিশের মতো শৃঙ্খলিত বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়বে।
এমআর/এসকেডি