বাকরখানির নামকরণে আছে একটি ব্যর্থ প্রেমের বেদনাদায়ক ইতিহাস

প্রায় ২৫০ বছরের পুরনো ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারক বাকরখানি রুটি বা বিস্কুট হিসেবে পরিচিত ভোজনরসিকদের কাছে। স্ত্রী আরজুমান্দ বানুকে ভালোবেসে তাজমহল তৈরি করেছিলেন সম্রাট শাহজাহান। ঠিক তেমনি ভাবে সুন্দরী খনি বেগমকে ভালোবেসে প্রেমকে অমর করতেই আগা বাকের তৈরি করেছিলেন বাকের-খনি রুটি।

তৎকালীন প্রভাবশালী জমিদার আগা বাকের খানের সঙ্গে এই খাবারটির নামকরণে আছে একটি ব্যর্থ প্রেমের বেদনাদায়ক ইতিহাস। রাজধানীর লালবাগ কেল্লার কাছে সর্বপ্রথম বাকরখানির দোকান গড়ে উঠেছিল।

ইতিহাসের সোনালী অধ্যায়ে বাকের-খনি প্রেম

তুর্কিস্তানের বালক আগা বাকের ক্রীতদাস হিসেবে বাংলায় আসেন। পরে বাংলার সুবেদার নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ তাকে কিনে দত্তক পুত্র হিসেবে লালনপালন করেন। আগা বাকেরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়ে নবাব তাকে পড়ালেখা ও সমরবিদ্যা শেখান। সেসময় রাজধানী মুর্শিদাবাদে খনি বেগম নামে এক নর্তকী ছিলেন। একপর্যায়ে নর্তকী খনি বেগমের প্রেমে পড়ে যান আগা বাকের। কিন্তু খনি বেগমের প্রেম প্রত্যাশী ছিলেন আরও অনেকেই। আর এটা নিয়েই আগা বাকের চিন্তিত হয়ে পড়েন। 

নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর উজির জাহান্দার খাঁর ছেলে জয়নাল খাঁও নর্তকী খনি বেগমের প্রেমে পড়েন। একপর্যায়ে তিনি খনি বেগমকে নিজের ভালোবাসার কথা জানান খনি বেগমকে। কিন্তু খনি বেগম জয়নাল খাঁর প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জানান। ক্ষুব্ধ জয়নাল এটা সহ্য করতে না পেরে খনি বেগমকে জোরপূর্বক নিয়ে যেতে চাইলে আগা বাকের বাঁধা দেন।

বিশেষ প্রক্রিয়ায় ময়দা, সামান্য পানি ও ডালডার সমন্বয়ে বাকরখানি তৈরি করা হয়

এক পর্যায়ে জয়নাল খাঁ ও আগা বাকের একে অপরের সাথে মল্লযুদ্ধ শুরু করেন। তবে শর্ত ছিল- মল্লযুদ্ধে বিজয়ী ব্যক্তি খনি বেগমকে নিয়ে যাবে। যুদ্ধে আগা বাকেরের কাছে পরাজিত হন উজিরপুত্র জয়নাল খাঁ।

এই ঘটনার পর উজির জাহান্দার খাঁকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বলা হয়, তার ছেলে জয়নালকে হত্যা করে লাশ গুম করেছে আগা বাকের। এরপর ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে নবাবের কাছে আবেদন করেন উজির। অন্যদিকে, মৃত্যুর মিথ্যা খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগে জয়নাল জোর করে খনি বেগমকে নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে খনি বেগমকে উদ্ধার করতে জয়নালের পিছু নেন বাকের এবং বাকেরকে ধরতে তার পিছু নেন উজির জাহান্দার খাঁ।

একপর্যায়ে বাকেরকে হত্যা করতে উদ্যত হলে উজির নিজেই তার ছেলে জয়নালকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করেন। নিজের মৃত্যু অবধারিত বুঝতে পেরে এসময় জয়নাল নিজ হাতে তলোয়ারের আঘাতে খনি বেগমকে হত্যা করে। মারা যান জয়নাল খাঁ নিজেও।

যেভাবে নামকরণ বাকরখানি

নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়, খনি বেগমকে না পেলেও প্রেমের স্মৃতিকে চির অমর করতে আগা বাকের একধরনের শুকনো রুটি তৈরি করে তার নাম দিয়েছিলেন ‘বাকের-খনি’। পরে মানুষের মুখে ঘুরতে ঘুরতে এই খাবারের নাম হয়ে যায় ‘বাকরখানি’।

তন্দুরের মধ্যে আগুনের তাপে ৫ থেকে ৭ মিনিটেই তৈরি হয়ে যায় বাকরখানি

বাকরখানি তৈরির নিয়ম

বাকরখানি তৈরির জন্য সর্বপ্রথম একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় ময়দা, সামান্য পানি ও ডালডার সমন্বয়ে খামির তৈরি করা হয়। এরপর ওই খামির থেকে কেটে ছোট ছোট গোলাকার কোয়া তৈরি করা হয়। এবার বেলুন দিয়ে কাঠের পিঁড়িতে কোয়াটি দিয়ে গোলাকার কাঁচা রুটি তৈরি করা হয়। 

এরপর কাঁচা রুটির মাঝখানে ছুরি দিয়ে লম্বা করে তিনটি দাগ কেটে দেওয়া হয়। এবার এর একপাশে পানির সামান্য প্রলেপ দিয়ে তন্দুরের দেয়ালে আটকে দেওয়া হয়। এরপর ৫ থেকে ৭ মিনিটেই আগুনের তাপে তৈরি হয়ে যায় বাকরখানি।

যেখানে পাওয়া যায় বাকরখানি

বাকরখানি তৈরির সব দোকানই মূলত পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। এরপর সেখান থেকে প্যাকেটে ভরে ধানমন্ডি, উত্তরা, বনানী, গুলশানসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার দোকানে সরবরাহ করা হয়।

বর্তমানে পুরান ঢাকা ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়ও গড়ে উঠেছে বাকরখানির দোকান। পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়ি, সূত্রাপুর, নারিন্দা, সিদ্দিক বাজার, আলু বাজার, চানখাঁরপুল, আগা নবাব দেউড়ি, কোতোয়ালি, চকবাজার, হাজারীবাগ, ওয়ারী, নয়া বাজার, রায়সাহেব বাজার, দয়াগঞ্জ, বংশাল, নাজিম উদ্দিন রোড, লালবাগ এলাকায় বাকরখানির দোকান পাওয়া যায়।

সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশে

বর্তমানে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাকরখানি রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও। পুরান ঢাকার বিখ্যাত এই খাবার ভারত, মধ্যপ্রাচ্যের কুয়েত, সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়।

দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাকরখানি রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও

সুস্বাস্থ্য ও রুচিভেদে বাকরখানি

বাকরখানি সাধারণত দুটি স্বাদের হয়। একটি মিষ্টি, অন্যটি নোনতা। নোনতা বাকরখানি সাধারণত ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য তৈরি করা হয়। তবে এই দুই স্বাদের বাইরেও আরও বিভিন্ন ধরনের বাকরখানি পাওয়া যায়। গরু ও খাসির মাংস দিয়েও এক ধরনের বাকরখানি তৈরি করা হয়। সাধারণত ঈদের সময় এই ধরনের বাকরখানি বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয়।

অনেক জায়গায় ক্ষীর ও পায়েসের সঙ্গেও পরিবেশন করা হয় বাকরখানি। নোনতা, কাবাব, ছানা, পনির, চিনি ও নারিকেলের সংমিশ্রণেও তৈরি হয় বাকরখানি। আবার ঘি দিয়েও বিশেষ প্রক্রিয়ায় বাকরখানি তৈরি হয়ে থাকে। 

অতীতে নবাবদের জন্যে ময়দার সঙ্গে দুধের মালাই ও মাখন মিশিয়ে খামির তৈরি করে বাকরখানি বানানো হতো। মালাই-মাখনের বাকরখানি বর্তমানে তৈরি করা হয় না। কিন্তু ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে থাকা পুরান ঢাকার পরিবারগুলোর সামাজিক অনুষ্ঠানে মালাই-মাখনের বাকরখানি এখনও আপ্যায়ন তালিকায় রাখা হয়।

সুলভমূল্যে বাকরখানি

বাজারে বাকরখানি কেজি হিসেবে অথবা পিস হিসেবে বিক্রি করা হয়। স্বাদ ও আকারভেদে ৩০ থেকে ৪৫টি বাকরখানি প্রতি কেজিতে পাওয়া যায় এবং প্রতি কেজির মূল্য সাধারণত ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।

টিএম/এমএইচএস