প্রতীকী ছবি

দেশের টাকা পাচার প্রতিরোধসহ মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ দমনে ফাঁকফোকর বন্ধ করে আইন সংশোধনের উদ্যোগের পক্ষে মত দিয়েছে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স।

বিদেশে পাচার করা সম্পদ ফেরত আনাসহ মানিলন্ডারিং বিষয়ে সার্বিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বুধবার (৩০ ডিসেম্বর) এক জরুরি বৈঠকে এমন সিদ্ধান্তের পক্ষে মত দিয়েছেন টাস্কফোর্স সদস্যরা।

অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিনের সভাপতিত্বে এ বিষয়ে ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের সদস্য সচিব ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এর ডেপুটি মো. ইস্কাদার মিয়া, এনবিআর চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, দুদক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা ভার্চুয়াল সভায় যুক্ত হন।

বৈঠকে যোগ দেওয়া এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, বৈঠকে অর্থপাচার ও এ সংক্রান্ত অপরাধ সংশ্লিষ্ট বিষয় ছিল আলোচনার প্রধান ইস্যু। বৈঠকে মানিলন্ডারিং আইনের দুর্বলতাগুলো উপস্থাপন করার পাশাপাশি তা দূর করতে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়। প্রয়োজনে সভায় উপস্থিত সদস্যরা আইন সংশোধনের উদ্যোগের বিষয়ে একমত পোষণ করেন।

সভা শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, অর্থপাচার আইনের যে দুর্বল দিকগুলো আছে তা বৈঠকে উপস্থাপিত হয়েছে। সেগুলো সংশোধনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

দুদক ও এনবিআর সূত্রে জানা যায, বিগত পাঁচ বছরে বিভিন্ন সংস্থার কাছে অর্থপাচার সংক্রান্ত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদন জমা হয়েছে। যা নিয়ে কাজ করছে আইন অনুযায়ী অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্ত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত পাঁচটি সংস্থা। যার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

অর্থপাচারকারীদের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ও সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়ে গত ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দুদকসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে একটি পর্যবেক্ষণ দেন। এসময় দুদকসহ সরকারের ৫টি সংস্থাকে তদন্তের অগ্রগতি জানাতে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এর আগে হাইকোর্ট গত ২২ নভেম্বর ৫টি সংস্থাকে লিখিত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। আদালতের পর্যবেক্ষণমূলক বক্তব্য ছিল- অর্থপাচারকারীরা দেশের শত্রু। যারা দেশের টাকায় লেখাপড়া করে উচ্চশিক্ষিত হয়ে বিদেশে অর্থপাচার করছে, তারা কখনো দেশের বন্ধু হতে পারে না। তারা জাতির সঙ্গে বেইমানি করছে।

২০১১ সালে চোরাচালান প্রতিরোধে গঠিত আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স বাতিল করে বিদেশে পাচার করা সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনার বিষয়ে ২০১৩ সালে সরকার টাস্কফোর্স গঠন করে। অ্যাটর্নি জেনারেল অব বাংলাদেশকে আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালককে সদস্য সচিব করে ১০টি সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে টাস্কফোর্স হয়।

২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থপাচার করার ঘটনা দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত করে থাকে। বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থপাচারের ঘটনা তদন্ত করে এনবিআর। আর হুন্ডি বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থপাচার হলে তা পুলিশের সিআইডি তদন্ত করে।

অর্থপাচার রোধে বাংলাদেশে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন করা হয় ২০১২ সালে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর এ আইন সংশোধন করা হয়। আইন অনুযায়ী, বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পত্তি নিয়মবহির্ভূতভাবে পাচার মানিলন্ডারিং অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত।

মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অর্থ বা সম্পত্তি পাচার হিসেবে যেসব বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে, আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দেশের বাইরে সম্পত্তি বা অর্থ প্রেরণ বা রক্ষণ বা দেশের বাইরের যে অর্থ-সম্পত্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে এবং যা বাংলাদেশে আনয়নযোগ্য ছিল, কিন্তু তা আনা থেকে বিরত থাকা বা বিদেশ থেকে প্রকৃত পাওনা দেশে না আনা বা বিদেশে প্রকৃত দেনার অতিরিক্ত পরিশোধ করা ইত্যাদি। মানিলন্ডারিং অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন চার বছর ও সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তকরণ ও সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডও করা হতে পারে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থপাচার নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই)। জিএফআইয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি ও রফতানির মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বছরে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়।

আরএম/জেডএস