ঝড়ে স্থির থাকা মানুষটি হেরে গেলেন করোনার কাছে
প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন
পদ্মায় ঝড় উঠলে যখন অন্য সহকর্মীরা ভয় পেতেন, তিনি থাকতেন স্থির। কৌশল শিখিয়ে দিতেন কীভাবে ঝড়ের সময় নদীতে নৌযান চালাতে হবে। ধীরস্থির মানুষটির প্রকৌশলে জ্ঞান ছিল অগাধ। পদ্মাসেতু পরিদর্শনে গিয়ে যিনি কেঁদেছিলেন অঝোর ধারায়। তিনি সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। তিনি আর নেই।
টানা প্রায় দুই সপ্তাহ করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত হেরেই গেলেন তিনি। মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) রাত সাড়ে ১১টায় রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন আনোয়ার হোসেন। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল ১৫ এপ্রিল।
বিজ্ঞাপন
তার এই প্রয়াণে সওজ অধিদপ্তরে তার সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমেছে। সওজ অধিদফতরে সহকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। সওজ প্রকৌশলী সমিতি আনোয়ার হোসেনের প্রয়াণে শোক প্রকাশ করেছে। প্রয়াতের ঘনিষ্ঠজন সওজ অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জিকরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি নিয়মিতভাবেই আনোয়ার স্যারের খোঁজ রাখতাম। গত রাতে এই দুঃসংবাদ পেয়ে আমরা হতবাক হয়েছি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাত সাড়ে ১১টায় আনোয়ার হোসেনকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে এর কিছু সময় আগেই তিনি মারা যান।
সহকর্মীদের কাছ থেকে জানা গেছে, প্রায় দুই সপ্তাহ আগে আনোয়ার হোসেনের শরীরে করোনাভাইরোসের উপস্থিতি ধরা পড়ে। তিনি চিকিৎসা নেন রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসা নিয়ে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে বাসায় নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাসায় আবার অবস্থার অবনতি হলে গত ২৩ এপ্রিল তাকে সরাসরি একই হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। ২৬ এপ্রিল অবস্থার আরও অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। পেশাগত জীবনে জ্ঞানী, চৌকস, প্রজ্ঞাবান ও উপস্হিত বুদ্ধি সম্পন্ন স্থিতধী প্রকৌশলী ছিলেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
পদ্মাসেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান আবদুল কাদের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ২০০৬ সালের ২১ আগস্ট সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে আমি সড়ক ও জনপথ অধিদফতরে যোগ দিই। তখন আনোয়ার হোসেন অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন। ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি পদ্মাসেতু প্রকল্প পরিদর্শনে এসেছিলেন। সারাদিনই আমার সঙ্গে ছিলেন। সবসময় প্রশিক্ষণ ও তার অভিজ্ঞতা আমার কাছে বলছিলেন। আমাকেও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরামর্শ দেন। স্যার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সবসময় খবর দেখছিলাম। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তিনি ভালো হয়ে যাবেন। কিন্তু সব আশা ধূলিসাৎ করে দিয়ে গতকাল ইন্তেকাল করেন তিনি।
এ প্রকৌশলী বলেন, তিনি সেতু পরিদর্শনে এসে এক ব্যতিক্রমধর্মী কাজও করেন। সেতুর জাজিরা প্রান্ত থেকে ওঠার সময় হঠাৎ আমাকে বলেন, কাদের দাঁড়াও। ভয় পেয়েছিলাম আমি। পরে বলেন, দেশের এত বড় স্থাপনায় উঠব এর জন্য আগে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি। এরপর তিনি নিজে মোনাজাত করে অঝোরে কাঁদলেন এবং সরকার প্রধানসহ সবার জন্য দোয়া করে তবেই সেতুতে তিনি ডান পা-টা রাখলেন। এরপর বললেন, চলো কাদের। তার কণ্ঠটা আমার কানে ভাসছে।
সওজ অধিদফতরের অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) জ্যেষ্ঠ সড়ক প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ দিলীপ গুহঠাকুরতা স্মৃতিচারণ করে বলেন, আশির দশকের প্রথমার্ধে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যখন সওজ অধিদফতরে যোগদান করি, আনোয়ার স্যার তখন খুলনা সড়ক বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। লম্বা মিষ্টি চেহারা, ব্রিটিশদের মতো গৌরবর্ণ, কথাবার্তায় স্মার্ট, চালচলনে আভিজাত্য একজন সওজ অফিসার, যাকে জনারণ্যেও আলাদা করে চিনতে কষ্ট হয় না। তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল সওজ-এর প্রাক্তন প্রধান কার্যালয় রমনার সড়ক ভবনের এ-ব্লকের করিডোরে।
তিনি বলেন, আশির দশকের শুরুতে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁ নামে বাংলাদেশে প্রথম পাঁচতারকা হোটেল চালু হয়। সেই হোটেলের বিশাল হলরুমে অবকাঠামো উন্নয়ন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সেমিনার হয়েছিল। সেই সেমিনারে সওজ থেকে একমাত্র আনোয়ার স্যার একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন। একজন অতি জুনিয়র অফিসার হিসেবে আমি সেই সেমিনারে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন না করলেও আনোয়ার স্যার আমাকে তাঁর উপস্থাপিত প্রবন্ধের একটি কপি উপহার দিয়েছিলেন। সেটি পড়ে অনভিজ্ঞ আমি এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, আনোয়ার স্যারের এলেম (জ্ঞান) আছে। এই সেমিনারের কিছুদিন পর স্যার স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য বিলাত (ব্রিটেনে) যান। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ছাত্র হিসেবে তার বেশ পরিচিতি ছিল।
দিলীপ গুহঠাকুরতা বলেন, আনোয়ার হোসেন পেভমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং, সড়ক নেটওয়ার্ক পরিকল্পনা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে অনেক জানতেন। ২০০৫ সালে আনোয়ার হোসেন প্রকল্প পরিচালক হিসেবে সওজ-এর এসআরএনডিপি প্রকল্পে আসেন। আমি তখন সেই প্রকল্পের ঢাকার প্রকল্প ব্যবস্থাপক। সেই প্রথম তার সঙ্গে সরাসরি কাজ করার সুযোগ পাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়া-ভাঙ্গা সড়কের কোনো এক স্পটে এসে এসআরএনডিপি প্রকল্প উদ্বোধন করবেন, এমন কর্মসূচি হয়েছিল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি হিসেবে এপ্রিল মাসের একদিন পিডি (প্রকল্প পরিচালক) আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে আমরা কয়েকজন প্রকল্প কর্মকর্তা এবং কনসাল্টেন্টের ডেপুটি টিম লিডার মাওয়া ঘাট থেকে গোধূলি বেলায় একটা স্পিডবোটে পদ্মা পাড়ি দিয়ে অপর পারে যাচ্ছিলাম। নদীর মাঝপথে হঠাৎ কালবৈশাখী শুরু হলো। বিশাল বিশাল ঢেউ উঠল প্রমত্তা পদ্মায়। সেইসঙ্গে প্রবল বাতাস আমাদেরকে বোট থেকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ভয়ে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। একমাত্র ব্রহ্মপুত্র নদী পাড়ের মানুষ আনোয়ার হোসেন তখন ধীরস্থির। তিনি আমাদের সবাইকে বোটের টানা রড শক্ত করে ধরে থাকতে বললেন। একইসঙ্গে তিনি বোটের চালককে গাইড করতে থাকলেন কীভাবে ঢেউগুলোকে রাইট-অ্যাঙ্গেলে কেটে এগিয়ে যেতে হবে। এইভাবে তিনি নদীর মাঝে একটি বালুচরে বোটটি উঠিয়ে দিলেন। ঝড় থামলে সেদিন আমরা অপর পারে গিয়েছিলাম।
জানা গেছে, প্রয়াত আনোয়ার হোসেন ২০০৭ সালে এলপিআর–এ (বর্তমানে পিআরএল) যান। কিন্তু পূর্ণ অবসরে তিনি একদিনও থাকেননি। অবসরোত্তর ছুটির পর ইঞ্জিনিয়ারিং স্টাফ কলেজে যোগদান করেন আনোয়ার হোসেন। সেখানে আমৃত্যু ডিন হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি।
পিএসডি/এফআর/জেএস