ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল দুঃখ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী আপনি বলেন, স্বজন হারানোর বেদনা না কি আপনি বোঝেন! দুঃখিত, স্বজন হারানোর বেদনা আপনি বোঝেন, তবে সেটি নিজেরটা। নইলে এই শত শত মানুষকে যারা হত্যা করেছে, ৭০/৮০ জন শিশু কিশোর ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে তাদের বিচার করা হয়নি। ধরেননি।

তিনি বলেছেন, শ্রীলঙ্কায় আন্দোলনে ১০ জন বিক্ষোভকারীকে হত্যা করা হয়েছিল। তারও কম দম্ভ, ক্ষমতা, সেনাবাহিনী, পুলিশ ছিল না। ক্ষমতা ছেড়ে তিনি চলে গেছেন। আজকে বাংলাদেশে ১০ জন শিশু মারা গেছে। কমপক্ষে ২৬৭ জন মানুষ মারা গেছে। হত্যাকারীদের বিচার করেন। গণরুম কেন্দ্রিক অত্যাচারের অবসান করুন।

মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) দুপুর ১২টায় ডিআরইউ সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত ‘হত্যা, অবৈধ আটক ও নির্যাতনের বিচার চাই’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।

আসিফ নজরুল বলেন, আমি ঘুমাতে পারি না। কালকে ফোন এসেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ধরে নিয়ে গেছে ভাটারা থানা পুলিশ। অত্যাচার করা হয়েছে। বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একটা জায়গায় ব্লক রেইড করা হয়েছে। কারফিউ দিয়ে হেলিকপ্টারের আলো ফেলে চারদিকে ঘিরে দেশের সাধারণ শিক্ষার্থী, তরুণ-কিশোরদের গণগ্রেপ্তার করা হচ্ছে। দেখা হচ্ছে গায়ে আঘাতের চিহ্ন আছে কি না।

তিনি বলেন, আমি ঘুমাতে পারি না, কারণ যখন আমি শহীদ মুগ্ধের গল্প পড়ি। যে ছেলেটি আন্দোলনে গিয়েছিল বিস্কুট আর পানি দেওয়ার জন্য। সবাইকে বলছিল কারো পানি লাগবে কি না। এ রকম একটা ছেলেকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমি ঘুমাতে পারি না, যখন দেখি টিয়ারগ্যাস বাসায় ঢুকছে সেটি বন্ধ করতে গিয়ে তখন ১১ বছরের ছেলেটিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ছয় বছরের শিশু মারা গেছে। চার বছরের শিশু বারান্দায় মারা গেছে। শিশু-কিশোরদের হত্যা করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, একটা বর্ণনাও বাড়িয়ে বলছি না, ২৬৭ জন মারা গেছে। কালকে একটা দোকানে জিনিস কিনতে গিয়ে শুনছিলাম, স্যার হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে, আমরা বিশ্বাস করি, কিন্তু আমরা এই সরকারকে বিশ্বাস করতে পারছি না।

ঢাবির এই অধ্যাপক বলেন, আজকে যখন এইরকম হত্যাকাণ্ডের ক্ষত আমাদের বুকে, তখন দেশের প্রতিটি অঞ্চলে গণগ্রেপ্তার করা হচ্ছে, নির্যাতন করা হচ্ছে, তখন আমাদের মনে প্রশ্ন উঠছে, এই সরকার কি তরুন-ছাত্র-যুবকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে? এটা কি কোনো অধিকৃত ভূমি, এটা কি গাজা স্ট্রিট? এটা কি কাশ্মীর? এই দেশে যাদের গায়ে পুলিশের পোষাক দেখছি, তারা কি ভিন্ন দেশি বাহিনী? এরা কি আমাদের ট্যাক্সের বিনিময়ে চলে না? এরা কি আমাদের অর্থে লালিত না, এই অস্ত্র কি আমাদের ট্যাক্সের টাকায় কেনা না?

মুক্তিযুদ্ধের গান ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, আজকে ছয়টা শিশুর ছবি যখন বের হয়, ফেসবুকে দেওয়া হয়, বর্তমান সরকারে যারা আছেন, তাদের কারো নাম নিচ্ছি না। আপনাদের বুকে তো কোনো ক্রন্দন দেখি না, কষ্ট দেখি না। সারাক্ষণ স্থাপনা স্থাপনা স্থাপনা কষ্ট। এই সব স্থাপনা তো আমাদের টাকায় করা। আমরা কষ্ট পাবো, যন্ত্রণায় ভুগবো। আপনারা তো মেট্রো রেলে চড়েন না। আপনারা তো রাস্তায় যাবার সময় মানুষকে বেআইনিভাবে আটকে রাখেন। আজকে এই ছয়টা ফুল যে ঝরে গেছে, ১৯ অপ্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ মারা গেছে, বেওয়ারিস লাশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। একটা মাকে দেখলাম কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় আছড়ে পড়ছে, আমার ছেলেটা তো কোনো আন্দোলনে ছিল না। কিন্তু বাজার করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছে। এই সরকার কি সমস্ত তরুণকে গ্রেপ্তার করবে?

আসিফ নজরুল বলেন, ১৯৭১ সালে আমরা দেখেছি, হৃদয়ে গুলি করা হলে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘর সেই যুদ্ধে যোগ দেয়। আজকে প্রতিটা ঘরে অশান্তি, ক্ষোভ। প্রতিরোধের আহ্বান। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর কইরেন না। কেন আন্দোলন হচ্ছে এসব বলে মানুষের সঙ্গে আর ঠাট্টা মশকরা কইরেন না। আজকে আন্দোলন হচ্ছে হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে, পৃথিবীর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রাবাসে টর্চার সেল রয়েছে? যেখান থেকে মৃত্যুর খবর আসে। জোর করে ক্রীতদাসের মতো নির্যাতন করা হয়? আজকে গণরুম কেন্দ্রিক নির্যাতনের অবসান চেয়ে আন্দোলনে নেমেছে ছাত্ররা। আজকে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা প্রক্টররা ছাত্রদের প্রতিরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এসব নতুন ঘটনা না। আজকে তাদের পদত্যাগের দাবি আসছে। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে যে নয় দফা দাবি আসছে, তা জোর করে পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে ছিল দায়ী মন্ত্রীদের পদত্যাগ।

তিনি বলেন, আজকে ৭০-৮০ বছরের মন্ত্রীরা, ছাত্রদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে। আমাদের তরুণ সমাজের একটা অংশকে ক্রীতদাস, আরেকটা অংশকে খুনি বানানো হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াতে যারা সরাসরি জড়িত শিক্ষার্থীরা তাদের বিচার চেয়েছে। শিক্ষার্থীরা তো সরকার পতনের ডাক দেয়নি, চায়নি নতুন নির্বাচন। তাহলে মানছেন না কেন? নিজে যদি খুনি না হন তাহলে খুনিদের বিচার কেন করছেন না? সমস্যা কি?

তিনি বলেন, আজকে আবু সাঈদের বুকে গুলি করে হত্যা করার পর এজহারে লেখা হয়েছে আন্দোলনকারীদের ইটপাটকেলে মারা গেছে। ফাজলামি করেন আপনারা? আমাদের কিশোর ছাত্ররা এখন সাহসের নাম। আমরাও আর অত্যাচারির অত্যাচারকে ভয় পাই না। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। কোনো ছাড় নাই।

তিনি আরও বলেন, আজকে শোক দিবস পালন করেন। জাতির সঙ্গে রসিকতা করেন? নাশকতার নামে ১০ হাজার গ্রেপ্তার করেছেন। আড়াই লাখ আসামি। হত্যা মামলায় কতজনকে গ্রেপ্তার করেছেন? আজকে পত্রিকার ফুটেজে দেখেছি, ছাত্রলীগ, যুবলীগের হাতে অস্ত্র। ইউনিফর্ম পরা পুলিশ। সবাই চিহ্নিত। জ্বলন্ত প্রমাণ এরপরেও তো কাউকে দেখিনি গ্রেপ্তার করতে? নাশকতা কারা করেছে আমরা তো এখনো প্রমাণ পাইনি। অথচ হাজার হাজার মানুষ গ্রেপ্তার করে ফেলেছেন। যেটার প্রমাণ রয়েছে, সেটির জন্য কাউকে ধরেননি। সম্পদ, স্থাপনার চেয়ে মানুষের জীবন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও দাবি।

আসিফ নজরুল বলেন, তাদের কাছে না কি এগুলো আছে, প্রতি সেকেন্ডে পাঁচ বছর ধরে গুলি করলেও না কি গুলি শেষ হবে না। এমন কথা বলা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারেন অন্তত মন্ত্রীসভা থেকে বাদ দেন। মানুষের বুকের ক্ষত-ক্রোধ কমান। মানুষের বুকে গুলি করে আরও উত্তেজিত করে কীভাবে ভাবেন সবাই ভুলে যাবে?

এ সময় উপস্থিত ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্ত্রী শিরীন হক, বাংলাদেশের বেসরকারি সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম ইন বাংলাদেশের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবির) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন, ঢাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মির্জা তাসলিমা সুলতানা।

জেইউ/কেএ