নিরাপত্তাকর্মীর বয়ান
‘ঘুমের মধ্যে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, তাকাতেই দেখি আগুন’
‘আমি তখন ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ নিশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। সজাগ হয়ে দেখি রুমের ভেতরে ধোঁয়া। দ্রুত বের হয়ে উপরের দিকে তাকাতেই দেখি আগুন। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে দেখি দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।’
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেখার সময়ের বর্ণনা দিচ্ছিলেন ৭নং ভবনের নিরাপত্তাকর্মী মাহফুজ মিয়া। তিনি রাতে ভবনের স্টোর রুমে ঘুমাচ্ছিলেন।
বিজ্ঞাপন
মাহফুজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি ধোঁয়া আর ধোঁয়া। এর মধ্যে সচিবালয়ের ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটও চলে এসেছিল।
নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে আরও দায়িত্বে ছিলেন জামাল মিয়া ও তৌহিদ। তারাও ঘুমিয়ে ছিলেন।
বিজ্ঞাপন
নিরাপত্তাকর্মী জামাল মিয়া বলেন, আগুন কীভাবে লাগল আমরা বুঝতে পারিনি। হঠাৎ ভবনের মাঝখানে আগুন দেখেছিলাম। পরে দেখলাম পশ্চিম পাশ জ্বলছে। এরপর দেখলাম আবার পূর্ব পাশে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিকেও আগুন লেগেছে। মূলত তিন স্পটে আলাদাভাবে আগুন লেগেছে।
আরও পড়ুন
জামাল বলেন, সাধারণ শর্ট সার্কিটের আগুন হলে এক দিকে লাগবে এরপর ছড়াবে। কিন্তু তিনটি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় আগুন লাগার কারণ বুঝতে পারলাম না। সিঁড়িতেও আগুন দেখেছিলাম। পরে আমরা কেউ উপরে যেতে পারিনি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাই উপরে গেছে।
তিনি বলেন, আমাদের কাছে শুধু বৈদ্যুতিক সাব স্টেশনের চাবি ছিল। বাকি সব চাবি ছিল পুলিশের কাছে। তারাই এসব গেট খুলে।
জানা গেছে, আগুন লাগার সময় সচিবালয়ের অন্য ভবনের পাশে মো. ইমরান হোসেন ও সাইফুল ইসলাম নৈশ প্রহরীর দায়িত্বে ছিলেন। মোট এই পাঁচজন ছাড়াও ওই দিন ডিউটি করার কথা ছিল ১১ জনের। কিন্তু ৫ জন বাদে বাকিরা ছুটিতে ছিলেন।
ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, রাত ১টা ৪৭-এর দিকে আমরা আগুন লাগার খবর পাই। গেটে ডিউটিতে থাকা পুলিশ সদস্যরা আমাদের খবর দেয়। আমরা গিয়ে দেখি ভবনের মাঝে আগুন। কিন্তু বেশি আগুন পশ্চিম দিকে জ্বলছে। আমরা পশ্চিম দিক থেকে কাজ শুরু করি। তখন উপরে উঠার গেট তালা দেওয়া ছিল। এতে আমাদের সময় ক্ষেপণ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কেউ তালা খুলে দিতে পারেনি। ৬নং ফ্লোর থেকেই আগুন উপরে উঠেছে। বিকট শব্দ হচ্ছিল। একটার পর একটা এসি বিস্ফোরিত হয়েছে। অগ্নিনির্বাপক বোতলগুলো বিস্ফোরিত হচ্ছিল। এর মধ্যে আমাদের হেড অফিসের টিম এসে ভবনের মাঝে কাজ শুরু করে। পরে দেখি পূর্ব দিকে বিশাল আগুন। সেখানেও আলাদা টিম কাজ করে।
এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা কয়েকটি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। প্রথমত এই ভবন তালা দেওয়া থাকায় ঢুকতে সমস্যা হয়েছে। এরপর ভবনের উপরের ফ্লোরেও তালা থাকায় বাধাপ্রাপ্ত হয়েছি।
তিনি বলেন, ভবনের ইন্টেরিয়রে ছিল দাহ্য পদার্থ। এসব বস্তুতে একবার আগুন লাগলে শুধু ছড়ায়। এতে এক ধরনের তারফিন তেল থাকে। যা দ্রুত আগুন ছড়ানোর সহায়ক। এসি আর ফায়ার এক্সটিংগুইশার বিস্ফোরিত হচ্ছিল আর আগুন দলা বেধে ছিটে আসছিল।
তিনি আরও বলেন, আমরা দেখেছি ভবনের উপরের ফ্লোরগুলোতে হোজ রিল আছে। এটা এক ধরনের পানির লাইন। এই লাইনের সঙ্গে একটা ব্রাঞ্চ পাইপ থাকে, সেটা লাগানো ছিল না। এই পাইপ থাকলে যে কেউ প্রাথমিকভাবে আগুন নেভানোর কাজ করতে পারে। এটা অকেজো ছিল। এই হোজ রিল সচল থাকলে আমাদের কাজ আরও সহজ হতো। এখানে বড় বাধা পেয়েছি। এছাড়া এ ভবনের নিচে রয়েছে ৫০০ কেভিএ ও ১২৫০ কেভিএ বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্র। সেখান থেকেই ১১০০ ভোল্টের বিদ্যুৎ সাপ্লাই হয়।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সচিবালয়ে ৭নং ভবনের ৬ থেকে ৯ তলা পর্যন্ত বিভিন্ন ফ্লোর ধ্বংসস্তূপ হয়ে গেছে। ৫টি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথি, চেয়ার-টেবিল, এসি এবং অন্যান্য আসবাবপত্রের বেশিরভাগই পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। চারপাশে শুধু পুড়ে যাওয়া ছাই আর বিস্ফোরণে চূর্ণ বিচূর্ণ হওয়া কাঁচের টুকরো ছাড়া আর কিছু নেই।
ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শন করা এক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, আমাদের স্থানীয় সরকার বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে ছাই ছাড়া কিছুই দেখতে পাইনি। সবগুলো দরজা পুড়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ নথির বেশিরভাগ পুড়ে গেছে। কিছু পানিতে ভিজে শেষ হয়ে গেছে। চেয়ার টেবিল, এসি, ফ্রিজ, ফ্যান, বইখাতা কিছুই চেনা যাচ্ছে না। হাঁটতেও সমস্যা হচ্ছে। পা বাড়ালেই শুধু কাঁচের টুকরো।
বৃহস্পতিবার সকালে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়িগুলো ভেতরে ঢোকানো যাচ্ছিল না। তাই গেট ভেঙে দুটি গাড়ি ঢোকানো হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ২১১ জন কর্মী আগুন নিয়ন্ত্রণের নিয়োজিত ছিল।
ট্রাকচাপায় নিহত সোয়ানুর জামান নয়ন
বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) দিবাগত মধ্যরাতে সচিবালয়ে আগুন নেভানোর সময় ট্রাকচাপায় আহত হন সোয়ানুর জামান নয়ন। তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের স্পেশাল এ ফাইটারকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। নিহত সোয়ানুর জামান নয়ন (২৪) রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বড়বালা ইউনিয়নের ছড়ান আটপড়িয়া গ্রামের কৃষক আখতারুজ্জামানের ছেলে। তিনি দুই বছর ধরে ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত ছিলেন।
গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি
সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ এই কেপিআইতে আগুন লাগার ঘটনার ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খালেদ রহিমকে প্রধান করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সরকার।
এর আগে এক ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ফায়ার সার্ভিসে রাত ১টা ৫২ মিনিটে খবর দেওয়া হয়, তারা ১টা ৫৪ মিনিটে এসে কাজ শুরু করে। সকাল আটটা পাঁচ মিনিটে আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার ফাইটারের একজন মারা গেছেন। দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে। তিনি একটি পাইপ নিয়ে সচিবালয় থেকে বের হয়েছিলেন, এ সময় একটা ট্রাক তাকে ধাক্কা দেয়। তার সঙ্গে আরও দুই থেকে তিনজন আহত হয়েছেন। তারা সবাই সুস্থ আছেন।
এমএম/এমএসএ