পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন

বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে ‘ইসরায়েল ছাড়া বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রে বৈধ’ কথাটি বাদ দেওয়া কূটনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো বড় ডিল নয় বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, এটা আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না। কারণ, পাসপোর্ট থেকে ‘এক্সসেপ্ট ইসরায়েল’ বাদ দেওয়া মানে দেশটিকে স্বীকৃতি দেওয়া নয়।

রোববার (২৩ মে) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জুলিও কুরি পদক’ প্রাপ্তির ৪৮তম বার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা বলেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ই-পাসপোর্ট চালু করেছি। আমরা এই পাসপোর্টটা খুব স্ট্যান্ডার্ড করে তৈরি করেছি। প্রায় ছয় মাস আগে আমরা যখন ই-পাসপোর্ট করি তখন তাতে যে একটা সিল লাগানো হতো ‘এক্সসেপ্ট ইসরায়েল’- আমরা এটা ডিলেট করেছি। আমরা স্ট্যান্ডার্ড পাসপোর্টের জন্য এটা করেছি। এটার অর্থ এই নয় যে, পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন হয়েছে। আমরা এখনো ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিইনি। ফিলিস্তিনের পক্ষে এখনো আমরা অত্যন্ত সোচ্চার।’

ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে বাংলাদেশ আগের অবস্থানে আছে উল্লেখ করে মোমেন বলেন, ‘আমরা একই অবস্থানে আছি। সুতরাং এটা কোনো বিগ ডিল নয়, এটা পাসপোর্ট, একটা আইডেনডিটি। ছোট লেখাটা বাদ দিয়েছি। আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বহু দেশের পাসপোর্ট দেখেছেন। যারা এটা তৈরি করেছেন তারা আমাদের এটা দেখিয়েছেন। তারা আমাদের বলেছেন, এটা বাদ দিলে খুব বড় কিছু হবে না।’

পাসপোর্টে এ পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে মোমেন বলেন, ‘অন্যান্য দেশে এভাবে হয়। লেখাটা বাদ দিয়েছি মানে এমন নয় যে, আপনি ইসরায়েলে যেতে পারবেন। সেটা আমরা এখনো অনুমতি দিইনি।’

দীর্ঘদিন আগের এ সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে এসে পরিবর্তন করলেন কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে এটার চিন্তা করা হয়েছে।’ 

এদিকে, বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে ইসরায়েলের নাম বাদ দেওয়ায় এরইমধ্যে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উপ-মহাপরিচালক গিলাড কোহেন। শনিবার (২২ মে) এক টুইট বার্তায় গিলার্ড কোহেন লিখেছেন, বড় খবর। ইসরায়েলে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ। এটি একটি স্বাগত পদক্ষেপ। আমি বাংলাদেশ সরকারকে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। আশা করি, এতে আমাদের উভয় দেশের জনগণ উপকৃত ও সমৃদ্ধ হতে পারে।

বাংলাদেশের পাসপোর্টে এ পরিবর্তন নিয়ে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, পাসপোর্টে আন্তর্জাতিক মান রাখতে গিয়ে এ পরিবর্তন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘পাসপোর্ট থেকে ইসরায়েরেলের নাম বাদ দেওয়ার বিষয়টি প্রশাসনিক। এটার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি টেনে আনা প্রাসঙ্গিক নয়। ইসরায়েলের সঙ্গে শুধু বর্তমান সরকার নয়, ভবিষ্যতেও অন্য কোনো সরকার কূটনৈতিক সম্পর্কে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না তারা।’

বাংলাদেশি নাগরিকদের পাসপোর্টে এক সময় তাইওয়ান ও দক্ষিণ আফ্রিকার নামেও নিষেধাজ্ঞা ছিল। পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে এ দুটি দেশের নামও উঠিয়ে নেয় বাংলাদেশ সরকার। তবে ইসরায়েল নামটি থেকে যায়। সম্প্রতি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ চলার সময় বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে ইসরায়েলের নাম বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গটি উঠে আসে।

ফিলিস্তিনের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক সম্পর্ক। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে ঢাকা বরাবরই ফিলিস্তিনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সবশেষ, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের হামাসের যুদ্ধেও ফিলিস্তিনের পক্ষেই শক্ত সমর্থন দিয়েছে ঢাকা। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হা‌সিনা ফি‌লি‌স্তি‌নের প্রতি সমর্থন জা‌নি‌য়ে দেশ‌টির প্রেসি‌ডেন্ট মাহমুদ আব্বাস‌কে লেখা চি‌ঠি‌তে উল্লেখ ক‌রেন, পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ১৯৬৭ সালের চুক্তি অনুযায়ী একটি স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। শুধু তাই নয়, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) নির্বাহী পরিষদের জরুরি বৈঠকে ফিলিস্তিনের পক্ষে সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশ ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। সে বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেছেন, ইসরায়েল যেকোনো যুক্তি ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। তা‌দের কা‌ছে নিরীহ বেসামরিক নাগরিক হত্যার ন্যায্যতা প্রমাণ করতে পারে এমন কোনো অজুহাত নেই। এটা কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত ও সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পাসপোর্ট থেকে ইসরায়েলের নাম তুলে দিলেই যে কূটনৈতিক সম্পর্ক হয়ে গেল এটা ভাবা ঠিক হবে না। এটা অনেক বড় সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তাইওয়ানের নাম বাদ দেওয়ার পর বাংলাদেশ কিন্তু তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে যায়নি, কেননা দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক করলে আমাদের চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হবে। অনেকে অযথাই একটা বিতর্ক সৃষ্টি করতে চায়। এটাকে বলা যায় পাসপোর্টের এক ধরনের আপডেট, যেভাবে তাইওয়ানের নামটা বাদ পড়েছে, একইভাবে ইসরায়েলেরটাও বাদ পড়েছে। ফিলিস্তিনের বিষয়ে বাংলাদেশের যে অবস্থান বা যে শক্তিশালী সম্পর্ক, আমার মনে হয় এই সরকার কেন ভবিষ্যতেও কোনো সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে যাবে না।’

এনআই/এইচকে/জেএস