মার্কিন শুল্কারোপ দুর্যোগ নয়, সুযোগ বিবেচনায় কার্যকর পদক্ষেপের আহ্বান
বাংলাদেশ হতে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপকে অনেকেই দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করছেন, তবে আমাদেরকে একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
শনিবার (১৭ মে) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এবং বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) যৌথভাবে আয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক শুল্ক এবং বাংলাদেশের কর্ম-পরিকল্পনা— শীর্ষক সেমিনারে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
বিজ্ঞাপন
সেমিনারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান প্রধান অতিথি ও ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স-বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মূল প্রবন্ধে উপস্থাপনকালে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের পরিস্থিতিকে অনেকেই দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করছেন, তবে আমাদের এটিকে একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। আরোপিত পারস্পরিক শুল্কের প্রভাব মূলত পড়বে ভোক্তার ওপর এবং বৈশ্বিক বাজার সেটাকে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করবে না। এটি কতটা কার্যকর হবে, সে বিষয়ে তিনি সংশয় প্রকাশ করেন। এছাড়াও বিষয়টি কেবলমাত্র অর্থনৈতিক নয় বরং অনেকাংশেই ভূ-রাজনৈতিক বলে তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন।
বিজ্ঞাপন
এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে সেবা খাতকে প্রাধান্য না দিয়ে পণ্য বাণিজ্যকে বেশি হারে গুরুত্ব দিয়েছে। বিষয়টি বাংলাদেশের নেগোসিয়েশনের ক্ষেত্রে সেবা খাতকে প্রাধান্য দিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চালানো প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর বাজার ততটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও আমাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজার যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, তাই বিষয়টি নিয়ে সুগঠিত, বহুমাত্রিক এবং বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে কার্যকর পদক্ষেপ দ্রুত গ্রহণ করতে হবে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র হতে পণ্য আমদানি বাড়িয়ে দুদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে আমরা আগ্রহী এবং এ লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র হতে তুলা আমদানিতে বাংলাদেশে ওয়ারহাউস স্থাপনের কথা ইতোমধ্যে বলা হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র হতে দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি আমদানির চুক্তি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে দুদেশের মধ্যকার ১ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য বাড়বে। তৃতীয় দেশ হতে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানির বিষয়টি প্রথম আলোচনা পর্বে উপস্থাপন করা হবে, যেন তারা এটাকে সরাসরি বাণিজ্য হিসেবে গণ্য করে, এক্ষেত্রে সেবাখাতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হবে।
স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি বাংলাদেশ হতে সেদেশে পণ্য রপ্তানির ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, যদিও তা ৯০ দিনের জন্য সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্তের ফলে আমাদের রপ্তানির অন্যতম বাজার সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে দেশের শ্রমের মান উন্নয়ন ও শ্রমবাজারের স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হতে পারে। এমতাবস্থায় দেশের রপ্তানি খাতের সুরক্ষা ও টেকসই করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও কৌশলগত উদ্যোগ গ্রহণ অতীব জরুরি।
মার্কিন পারস্পরিক শুল্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ, রপ্তানির বাজার রক্ষা ও সম্প্রসারণের রাজনৈতিক উদ্যোগ ও প্রয়োজনীয় সংস্কার, নিজেদের রপ্তানি বহুমুখীকরণের পাশাপাশি ব্যবসায়িক অংশীদারদের সম্পর্ক উন্নয়নের ওপর তিনি জোরারোপ করেন।
আইসিসি বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদেরকে সঠিক পদ্ধতিতে কার্যকরভাবে নেগোসিয়েশন চালিয়ে যেতে হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করেছে তা কাম্য নয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্তকরণ আশানুরূপ নয়, তাই সরকারের সাথে উদ্যোক্তাদের সম্পর্ক আরও জোরালো হতে হবে। তবে কোনো একক বাজারের ওপর রপ্তানির নির্ভরশীলতা কমিয়ে নতুন গন্তব্য যেমন- এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার প্রতি আমাদের মনোনিবেশ বাড়ানো প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
সেমিনারের নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. মেসবাউল হক, ঢাকা চেম্বারের প্রাক্তন সভাপতি ও শাশা ডেনিমস্ লি.-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ, পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. এম মাশরুর রিয়াজ এবং বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস্ অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার রাজিব হায়দার অংশগ্রহণ করেন।
ড. এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কী চায় এবং তাদের ভূ-অর্থনৈতিক প্রাধিকার কী, সেটা আমাদের আগে জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তুলা, সয়াবিন, এলএনজি-এ তিনটি পণ্যের আমদানি বাংলাদেশে ক্রমাগত বাড়ছে, তাই এ ধরনের সম্ভাবনাময় পণ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।
আরএম/এমজে