আঞ্চলিক ইস্যুতে ড. ইউনূসকে কী বার্তা দিলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী?
আঞ্চলিক সহযোগিতা ও শান্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সবার সঙ্গে কাজ করবে— এমনটাই দেখতে চায় বন্ধুপ্রতিম জাপান। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এ বার্তা দিয়েছেন।
ঢাকা-টোকিওর কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, জাপানের স্থানীয় সময় শুক্রবার (৩০ মে) টোকিওতে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ইউনূস-শিগেরু সব মিলিয়ে আধা ঘণ্টার মতো বৈঠক করেন। বৈঠকে তারা অর্থনৈতিক সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা, ইন্দো-প্যাসিফিক, রোহিঙ্গা, মানবসম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন সহযোগিতার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী দেশটির কোনো বন্ধুপ্রতিম দেশের নাম উল্লেখ না করে আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং আঞ্চলিক শান্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ড. ইউনূসকে একটি বার্তা দিয়েছেন। শিগেরু বলেছেন, এ ইস্যুতে বাংলাদেশ সবার সঙ্গে কাজ করবে— এমনটাই চাওয়া দেশটির।
বিজ্ঞাপন
জাপানের প্রধানমন্ত্রীর এমন বার্তা কিসের ইঙ্গিত করে, জানতে চাওয়া হয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদের কাছে। ইমতিয়াজ মনে করেন, জাপানের সঙ্গে মিয়ানমারের একটি ভালো সম্পর্ক আছে, বড় সম্পর্ক আছে। আমার মনে হয়, জাপান এটা বোঝাতে চাইছে যে সবার মধ্যে যেন ঐকমত্য থাকে। করিডরের বিষয়টি মিয়ানমার পছন্দ করেনি। আরেকটা হলো, আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে সরকারিভাবে বলা, এটাও মিয়ানমার ভালোভাবে নেয়নি। আর ভারতের সঙ্গে জাপানের বিশাল সম্পর্ক আছে, এটাও মনে রাখতে হবে। আমার মনে হয়, আশপাশে যেসব দেশ আছে, তাদের মধ্যে যেন ঐকমত্য থাকে— এটাই বোঝাতে চেয়েছে জাপান।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
সরকারপ্রধানের টোকিও সফরে অর্থনৈতিক, বিনিয়োগ ও অন্যান্য সহযোগিতা বিষয়ে ছয়টি সমঝোতা স্মারক সই করেছে জাপান ও বাংলাদেশ। যার মধ্যে— জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এবং বাংলাদেশের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে প্রথম সমঝোতা স্মারকটি সই হয়। বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বিএসইজেড)-এর জমি ইজারা চুক্তির জন্য জাপানের ওনোডা ইনকরপোরেশনের সঙ্গে দ্বিতীয় সমঝোতা স্মারকটি সই হয়। তৃতীয় সমঝোতা স্মারকটিও বিএসইজেড-এর একটি জমি ইজারা চুক্তির জন্য বাংলাদেশ ন্যাক্সিস কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে সই হয়। চতুর্থ সমঝোতা স্মারকটি গ্লাগিট, মুসাশি সেইমিৎসু ইন্ডাস্ট্রি গ্লাফিট এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিএ) মধ্যে সই হয়েছে।
পঞ্চম সমঝোতা স্মারকের আওতায় সাইফার কোর কোম্পানি লিমিটেড বাংলাদেশে তথ্য নিরাপত্তার জন্য ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। পুরস্কারপ্রাপ্ত উদ্ভাবক তাকাতোশি নাকামুরার কমপ্লিট সাইফার টেকনোলজির ওপর ভিত্তি করে এই প্রকল্প বাংলাদেশকে ডিজিটাল অর্থনীতিতে রূপান্তরে সহায়তা করবে। ষষ্ঠ এমওইউ জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এবং বিআইডিএ-এর মধ্যে সই হয়েছে।
এ ছাড়া, বাংলাদেশে বাজেট সহায়তা, রেলের উন্নয়ন এবং অনুদান হিসেবে ১০৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়েছে জাপান। যার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার এবং জলবায়ু স্থিতিশীলতার জন্য উন্নয়ন ঋণ হিসেবে ৪১ কোটি ৮০ লাখ ডলার দেবে জাপান। আর জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেলপথকে ডুয়াল গেজ ডাবল লাইনে উন্নত করতে ৬৪ কোটি ১০ লাখ ডলার পাওয়া যাবে। এছাড়া, বৃত্তি বাবদ ৪২ লাখ ডলার অনুদানও দেবে দেশটি। সরকারপ্রধানের জাপান সফরের তৃতীয় দিন এই চুক্তিপত্র বিনিময় হয়।
ইউনূস-শিগেরুর বৈঠকের পর এক যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি হস্তান্তর সংক্রান্ত চুক্তিতে বাংলাদেশ ও জাপান নীতিগতভাবে একমত হয়েছে এবং চুক্তিটি দ্রুত সম্পন্ন হওয়ার আশা প্রকাশ করেছে উভয়পক্ষ। পাশাপাশি উভয়পক্ষ রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও জোরদার করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। জাপানের অফিশিয়াল সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্সের অধীনে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে পাঁচটি টহল নৌকা দ্রুত সরবরাহের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে।
উভয়পক্ষ কৌশলগত অংশীদারত্বের প্রতি প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। তারা সবার জন্য শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য একটি মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকের জন্য তাদের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিও পুনর্ব্যক্ত করেছে। উভয়পক্ষ অর্থনৈতিক সংস্কার এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার জন্য উন্নয়ন নীতি ঋণের জন্য নোট বিনিময় স্বাক্ষর এবং জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী সেকশন (১)-এর মধ্যে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ঋণকে স্বাগত জানিয়েছে।
উভয়পক্ষ জাপানি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (বিডা) ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) সিস্টেম, প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপন, ব্যাটারিচালিত সাইকেলের জন্য কারখানা স্থাপন, তথ্য সুরক্ষার জন্য একটি পাইলট প্রকল্প চালু এবং বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (বিএসইজেড) সঙ্গে ভূমি চুক্তিসহ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরকে স্বাগত জানিয়েছে।
তারা (বাংলাদেশ-জাপান) পারস্পরিক লাভজনক উপায়ে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (ইপিএ) সম্পন্ন করার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছে এবং তাদের নিজ নিজ মন্ত্রণালয় ও আলোচক দলগুলোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য আলোচনা ত্বরান্বিত করার নির্দেশ দিয়েছে।
এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ড. ইউনূস জাপান-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে, বিশেষ করে মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগসহ (মিডি) বঙ্গোপসাগরীয় শিল্প বৃদ্ধি বেল্ট (বিগ-বি) উদ্যোগের আওতাধীন প্রকল্পগুলোতে বাংলাদেশে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নে অব্যাহত সহায়তার জন্য জাপান সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করতে সম্মত হয়েছে উভয়পক্ষ। যৌথ বিবৃতিতে রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার না করে বলা হয়েছে, উভয়পক্ষ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের মিয়ানমারে একটি টেকসই, নিরাপদ, স্বেচ্ছাসেবী এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করেছেন।
সরকারপ্রধানের জাপান সফর কেমন হলো— এমন প্রশ্নে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, যেটা হয়েছে, কিছু চুক্তিপত্র বিনিময়। কিন্তু কোনো চুক্তি না। নতুন চুক্তি হয়নি। কিছু হয়নি। সেই হিসেবে এটা গতানুগতিক সফর হয়েছে। যতক্ষণ নির্বাচিত সরকার না আসবে, ততক্ষণ তারা (বিদেশি) কেউ নড়বে না, এটা না বোঝার কোনো কারণ নেই।
এনআই/এমজে