আকাশের ছোবল থেকে প্রাণ বাঁচাচ্ছে মাঠের ‘লোহার খুঁটি’
বিকেল গড়াতে না গড়াতেই আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। গরমে হাঁসফাঁস করতে থাকা চারপাশে হঠাৎ ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা। সঙ্গে গর্জন করে ওঠে আকাশ। এরপর এক ঝলকে ছোবলের মতো নেমে আসে বজ্রপাত— এই দৃশ্য এখন আর নতুন কিছু নয়।
গত কয়েক বছর ধরে এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত, প্রতি বছরই এই মৌসুমে এমন চিত্র দেখা যায় দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে, বিশেষ করে উত্তর-পূর্বের হাওর ও পাহাড়ঘেরা এলাকাগুলোতে। তবে বজ্রপাত শুধু এখন আর প্রাকৃতিক বিষয় নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে মরণফাঁদ।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
গত এক দশকে বজ্রপাতে প্রাণ গেছে কয়েক হাজার মানুষের। সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন কৃষক, জেলে ও খোলা আকাশের নিচে কাজ করা শ্রমজীবীরা।
বিজ্ঞাপন
তবে এবার কিছুটা ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নে। সেখানে এক ধরনের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন মানুষ। কৃষকের মুখে ফিরে এসেছে সাহসের কথা। মাঠে কাজ করছেন তারা, মাথার ওপর বজ্রপাত হলেও আতঙ্কিত নন। কারণ, পাশে বসানো হয়েছে ‘বজ্র নিরোধক যন্ত্র’— যেটি স্থানীয়দের কাছে এখন ‘জীবন রক্ষাকারী প্রযুক্তি’ হিসেবেই পরিচিত।
জীবন ফিরে পাওয়ার গল্প
গাজীপুর ইউনিয়নের পাথরঘাটা গ্রামের কৃষক সুবেল মিয়া (৩৫)। পরিবারে স্ত্রী, দুই সন্তান আর মা। জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ৪ একর জমির ধান। আগের বছর বজ্রপাতে মারা যান তার আপন চাচাতো ভাই লতিফ মিয়া— সেই স্মৃতি এখনও দগদগে।
সুবেল বলেন, আমার ভাই ওই মাঠেই ধান কাটছিল, হঠাৎ বজ্র পড়ল। হাসপাতালে নিতেই পারি নাই। ওই ঘটনার পর মনে ভয় ঢুইকা গেছিল। কাজ বাদ দিয়া অনেকদিন বসে আছিলাম। তবে এখন সেই ভয় খানিকটা কমেছে। কারণ, ইউনিয়নের মাঝখানে বসানো হয়েছে ফ্রান্স থেকে আমদানিকৃত বজ্রনিরোধক যন্ত্র।
সুবেল জানান, এখন যন্ত্রটা দেখা যায় মাঠের পাশে। বজ্র পড়লেও মনে হয় দূরে পড়ছে। কাজ করি সাহসে।
একই ইউনিয়নের কৃষক সুলতান মিয়া বলেন, আমরা চাই সরকার এই যন্ত্র আরও বেশি বসাক। একটা যন্ত্র মানে কয়েক গ্রামের লোকের জান রক্ষা।
আরও পড়ুন
স্থানীয় উদ্যোগ ও সচেতনতা
গাজীপুর ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আমাদের ইউনিয়নে বজ্রপাতে অনেক কৃষক মারা গিয়েছেন। তবে যন্ত্র বসানোর পর আর কোনো প্রাণহানি হয়নি। মানুষও সচেতন হয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, এই যন্ত্রের পাশাপাশি আমরা মাইকিং করি, লিফলেট দিই, স্কুলে গিয়ে বাচ্চাদের শেখাই— বজ্রপাত হলে কী করতে হয়। আগে মানুষ পাতা গাছের নিচে দাঁড়াত, এখন তারা খোলা মাঠ ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে যায়।
প্রযুক্তির কার্যকারিতা ও সম্ভাবনা
সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বজ্রপাত নিরোধক এই যন্ত্রটি কাজ করে একদম বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে। এটি মূলত একটি ১৫ থেকে ২৫ ফুট লম্বা পোলের মাথায় বসানো একটি ধাতব ডিভাইস, যার ভেতরে থাকে ধাতব ট্রিগার ও চার্জ স্টোরেজ ব্যবস্থা। যন্ত্রটি সূর্যের আলো থেকে চার্জ নিয়ে পরিবেশে আয়ন ছড়িয়ে দেয়। বজ্রপাত যখন আকাশ থেকে মাটির দিকে নামতে চায়, তখন এই যন্ত্র সেটিকে নিজের দিকে টেনে নেয়। ফলে যন্ত্রের নিচে থাকা মানুষ, পশু, ঘরবাড়ি—সবই সুরক্ষিত থাকে। এই প্রযুক্তি বর্তমানে সরবরাহ করছে আভকনিক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
তাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহমুদুর রহমান বলেন, প্রযুক্তিটি একেবারে প্রমাণিত। শুধু মাঠ নয় রোহিঙ্গা ক্যাম্প, কারখানা, মাদ্রাসা, স্কুল, এমনকি পাহাড়ি এলাকাতেও আমরা স্থাপন করেছি। এটি ৯৭ থেকে ৪০০ মিটার পর্যন্ত এলাকা কভার করতে পারে।
তিনি আরও জানান, যন্ত্রটি সৌরশক্তি থেকে চার্জ গ্রহণ করে, আলাদা বিদ্যুৎ সংযোগের প্রয়োজন হয় না। এতে ই-সিম যুক্ত থাকায় সরাসরি তথ্য পাঠানো যায় ক্লাউডে। ফলে যেকোনো স্থান থেকে মোবাইল বা কম্পিউটারে এর কার্যক্রম মনিটরিং করা সম্ভব।
যন্ত্রটির কার্যকারিতা সম্পর্কে চুনারুঘাট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) নুর মামুন জানান, শুধু একটি খুঁটির মাধ্যমে ডিভাইসটি স্থাপন করা যায়, ফলে কৃষকের জমির কোনো ক্ষতি হয় না। এর কার্যকারিতা দেখে আরও এলাকাজুড়ে প্রযুক্তি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা থাকা উচিত।
আরও পড়ুন
বজ্রপাতের ঝুঁকি ও জাতীয় প্রেক্ষাপট
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের অন্তত ১৫টি জেলায় বজ্রপাতের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাক-বর্ষা মৌসুমে (মার্চ-মে) হাওর অঞ্চল— বিশেষ করে সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জে বজ্রপাতের ঝুঁকি অনেক বেশি। বর্ষা মৌসুমে (জুন-আগস্ট) এই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ে ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, রংপুর, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামে। এমনকি বর্ষা শেষেও (অক্টোবর-নভেম্বর) পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও নোয়াখালীতে বজ্রপাতের প্রবণতা থাকে, আর শীতকালেও সাতক্ষীরা, খুলনা ও পটুয়াখালীতে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে।
মূলত, ২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তখন আশা করা হয়েছিল, প্রতিরোধ ও সচেতনতায় বড় ধরনের কর্মসূচি নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনো অধিকাংশ বাজেট ব্যয় হয় সতর্কবার্তা প্রচারে প্রতিরোধে নয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও দুর্যোগ বিশ্লেষক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ডিটেকশন নয় বরং প্রটেকশনে যেতে হবে। বজ্রপাত প্রতিরোধক যন্ত্র এখন একমাত্র কার্যকর উপায়। তালগাছ লাগানো, ফ্ল্যাশ মেসেজ এসব সাময়িক। একেকটা যন্ত্র মানে একেকটা জীবনের নিরাপত্তা।
তিনি বলেন, প্রতি ইউনিয়নে অন্তত একটি প্রযুক্তি বসাতে পারলে বজ্রপাতে মৃত্যুহার ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
অন্যদিকে, তথ্য বলছে হাওরাঞ্চল বাংলাদেশের বজ্রপাতপ্রবণ প্রধান এলাকা। নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার অঞ্চলে প্রতি বছরই মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশে বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন ৩১২ জন। তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ ছিলেন কৃষি ও মৎস্য শ্রমিক। অথচ উন্নত দেশগুলোতে বজ্রপাতে মৃত্যুহার শূন্যের কাছাকাছি— কারণ তারা আগে থেকেই প্রতিরোধমূলক প্রযুক্তি স্থাপন করেছে।
তবে বাংলাদেশে বজ্রপাত প্রতিরোধে স্থানীয় উদ্যোগ দেখা গেলেও এখনো কেন্দ্রীয়ভাবে নেই কোনো নির্দেশনা বা নীতিমালা। বাজেটেও নেই নির্দিষ্ট বরাদ্দ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলক প্রযুক্তি বসানোর চিন্তা করছি। তবে তা এখনো পরিকল্পনার পর্যায়ে আছে। অথচ প্রতিবছর কয়েকশ কোটি টাকা বরাদ্দ হয় জলবায়ু খাতে। তার একটা অংশ যদি বজ্র নিরোধক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করা হয়, তাহলে হাজারো প্রাণ বাঁচানো সম্ভব।
আরএইচটি/এমজে