নগদ ডিস্ট্রিবিউটর অফিসের সোয়া কোটি টাকা ছিনতাই
ছুটির দিন সকালে বাইকে কেন বহন করা হয়েছিল এত টাকা?
সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও মাইক্রো বা টাকা বহন করা গাড়িতে না নিয়ে গত শনিবার (১৪ জুন) সকালে ব্যাগে ভরে বাইকের মতো অনিরাপদ যানবাহনে বহন করা হয়েছিল নগদের দুটি ডিস্ট্রিবিউটর অফিসের সোয়া কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, যে দুজনের ওপর টাকা বহনের দায়িত্ব ছিল, তারা ছিলেন অনুপস্থিত। তাদের অবর্তমানে অনভিজ্ঞ দুই সুপারভাইজারসহ চারজনের ওপর টাকা বহনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। চারজনকে ওই মোটা অঙ্কের টাকা বহনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন নগদের উত্তরা ডিস্ট্রিবিউটর অফিসের ম্যানেজার রিয়াজুল ইসলাম।
শনিবার (১৪ জুন) সকাল ৮টা ৫০ মিনিটের দিকে উত্তরা ১৩ নং সেক্টরের ১২ নং রোডে স্থানীয় ডিস্ট্রিবিউটর অফিসের এমডি আব্দুল খালেক নয়নের বাসা (৩৭ নং বাসা) থেকে দুটি ব্যাগে ভরে দুটি মোটরসাইকেলযোগে ১ কোটি ২২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা নিয়ে রওনা দেন চারজন। গন্তব্য উত্তরা ১৩ সেক্টরের ১৩ নং রোডের ৪৯ নং বাসা, যেখানে উত্তরার নগদের ডিস্ট্রিবিউটরের অফিস। কিন্তু উত্তরা ১৩ সেক্টরের ১৩ নং রোডের ৩৭ নং বাসার সামনে বাম পাশে পৌঁছাতেই আগে থেকেই অবস্থান নেওয়া কালো রঙের হাইস গাড়ি দুটি মোটরসাইকেলের গতি রোধ করে। পরে র্যাব পরিচয়ে ও র্যাবের কালো কটি পরিহিত ৮ থেকে ১০ জন অস্ত্রের মুখে চারজনকে জিম্মি করে ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। অনেকটা ফিল্মি স্টাইলেই কালো কাপড়ে ছিনতাইকারীদের মুখ ছিল ঢাকা। অস্ত্রের মুখে তিনজনকে টাকার ব্যাগসহ গাড়িতে ওঠানো হয়। একজন দৌড়ে পালাতে সক্ষম হন। যদিও তার কাছে থাকা ব্যাগে ছিল মাত্র ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা।
বিজ্ঞাপন
মোটা অঙ্কের টাকা কেন নগদের ডিস্ট্রিবিউটর অফিসের এমডি আব্দুল খালেক নয়নের বাসায় রাখা হয়েছিল? দায়িত্বপ্রাপ্তদের অনুপস্থিতিতে অন্য চারজনকেই বা কেন টাকা বহনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল? সোয়া কোটি টাকা কেন ব্যাগে ভরে দুটি মোটরসাইকেলে বহন করা হচ্ছিল? ঝুঁকি বিবেচনায় পুলিশের মানি এসকর্ট সেবা পেতে কেন যোগাযোগ করা হয়নি পুলিশের সঙ্গে?— এসব প্রশ্নের সদুত্তর খুঁজছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা।
তবে নগদ ডিস্ট্রিবিউটর অফিসের দুই এমডি’র কেউই কোনো সহকর্মীকে সন্দেহ করছেন না। নিজেদের ভুলকেই দুষছেন। বলছেন, ঈদের কারণেই এত টাকা জমে গিয়েছিল। মাত্র ২০০ গজ দূরত্ব ভেবেই বাইকে করে টাকা স্থানান্তরে ঝুঁকি মনে করেননি তারা।
বিজ্ঞাপন
চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ ছাড়াও তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঢাকা মেট্রো-উত্তর ও পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাব। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সন্দেহের তীর নগদের কর্মীদের দিকেই। তাদের মধ্যেই কেউ আগে থেকে বিষয়টি জেনে ছিনতাইয়ে সহযোগিতা করেছে। চাঞ্চল্যকর এই ছিনতাইয়ের ঘটনায় মোট পাঁচজনকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তাদের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানা হেফাজতে রয়েছেন নগদের উত্তরা ডিস্ট্রিবিউটর অফিসের ম্যানেজার রিয়াজুল ইসলাম, সুপারভাইজার সঞ্জয় কুমার, ওমর আহমেদ ও তুরাগ অফিসের ম্যানেজার মাসুদুর রহমান। অন্যদিকে মামলার বাদী আব্দুর রহমানকে ডেকে নিয়েছে ডিবি পুলিশ।
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় গত ১৪ জুন রাতেই উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। বাদী নগদের উত্তরা অফিসের মানি কালেকশন ম্যান আব্দুর রহমান।
নগদের উত্তরা অফিস সূত্রে জানা গেছে, ওই দিন নগদের দুটি অফিসের টাকা ছিনতাই হয়েছে— তুরাগ ও উত্তরা ডিস্ট্রিবিউটর অফিসের টাকা। টাকাগুলো ছিল ডিস্ট্রিবিউটরের অফিসের দুই এমডির একজন আব্দুল খালেক নয়নের উত্তরা ১৩ নং সেক্টরের ১২ নং রোডের বাসায় (৩৭ নং বাসা)। ছিনতাই হওয়া টাকার মধ্যে উত্তরা অফিসের টাকা ছিল ৪৪ লাখ আর বাকি টাকা তুরাগ অফিসের। এসব ঈদের আগের ও ঈদের সময়ের ট্রানজেকশনের টাকা। বুধ ও বৃহস্পতিবার অফিস খোলা ছিল। সে টাকাও নয়নের বাসায় ছিল। মামলায় ১ কোটি ৮ লাখ ১১ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের কথা উল্লেখ করা হলেও ছিনতাইকৃত টাকার পরিমাণ ১ কোটি ২১ লাখ।
নগদের উত্তরা অফিসের সুপারভাইজার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, উত্তরা নগদ ডিস্ট্রিবিউটর অফিসে কর্মীর সংখ্যা ২৭ জন। ম্যানেজার রিয়াজুল ইসলাম। তার অধীনে সুপারভাইজার তিনজন, অ্যাডমিন একজন, এসআর ১৮ জন, কালেকশন ম্যান তিনজন।
ওই দিন টাকা বহনের দায়িত্বে যে দুজন ছিলেন তারা অনুপস্থিত ছিলেন। যে দুজনের দায়িত্বে ছিলেন তারা হলেন- মো. আলামিন, তার বাসা দিয়াবাড়িতে। তিনি আসতে দেরি করেছিলেন। আরেকজন বিল্লাল আহমেদ ঈদের ছুটি থেকে তখনও গ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরেননি। তাদের অবর্তমানে নগদের উত্তরা ডিস্ট্রিবিউটর অফিসের ম্যানেজার রিয়াজুল ইসলাম সুপারভাইজার ওমর আহমেদ, মো. কাউসার, মানি কালেকশন ম্যান আব্দুর রহমান ও মো. লিয়াকতকে নির্দেশনা দেন যে টাকাটা নয়নের বাসা থেকে আনার জন্য। যদিও সুপারভাইজারদের কাজ টিম ম্যানেজ করা, টাকা বহন করা না। ওই দিন মোটরসাইকেলে করে ও ব্যাগে ভরে টাকাটা আনার পর পথে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
ওই কর্মকর্তা জানান, সুপারভাইজার ওমর আহমেদ ছিনতাইয়ের সময়ে দৌড়ে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার কাছে ছিল মাত্র ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। ঘটনার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানা ও ডিবি হেফাজতে রয়েছেন, নগদের উত্তরা ডিস্ট্রিবিউটর অফিসের ম্যানেজার রিয়াজুল ইসলাম, সুপারভাইজার সঞ্জয় কুমার, ওমর আহমেদ ও তুরাগ অফিসের ম্যানেজার মাসুদুর রহমান। অন্যদিকে মামলার বাদী আব্দুর রহমানকে ডেকে নিয়েছে ডিবি পুলিশ।
মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, তাকেসহ অন্য দুজন লিয়াকত ও কাউসারকে হাইস গাড়িতে ওঠিয়ে হাত ও চোখ বেঁধে মারপিট করে এবং বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। ছিনতাইয়ের ঘটনার ২৫ মিনিট পর সকাল আনুমানিক ৯টা ২০ মিনিটের দিকে তুরাগ থানার ১৭নং সেক্টরের বৃন্দাবন নামক স্থানে চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় টাকা ও অফিশিয়াল দুটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন ও ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নিয়ে তিনজনকেই গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে চলে যায়। পরবর্তী সময়ে একে অপরের সহযোগিতায় হাত ও চোখের বাঁধন খুলে লোকজন মারফত জানা যায়, টাকা নিয়ে হাইস গাড়িটি মিরপুরের দিকে চলে গেছে।
র্যাব পরিচয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, র্যাবের গোয়েন্দা ও অপারেশন বিভাগ ছাড়াও র্যাব-১ গভীরভাবে ছায়া তদন্ত করছে। এই ছিনতাইয়ের ঘটনায় যারা সন্দেহের ভেতরে আছেন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। যেসব ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট আমরা পেয়েছি সেগুলো বিশ্লেষণ করে অভিযান চলছে। নগদের উত্তরা অফিসের কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
র্যাবের কোনো সদস্য এই ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত রয়েছে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা বলার মতো সময় এখনো আসেনি। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে এই মুহূর্তে কিছু বলা ঠিক হবে না। আমরা সর্বাত্মক কাজ করছি। আশা করছি অপরাধীরা ধরা পড়বেন।
ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা অপরাধী তারা পুলিশ বা র্যাবের দুর্বলতা, ফাঁক-ফোকর ব্যবহার করে থাকে। সেদিন ছুটির দিন ছিল, তার মধ্যে সকাল বেলা মোটা অঙ্কের টাকা কেন নগদের ডিস্ট্রিবিউটর অফিসের এমডি আব্দুল খালেক নয়নের বাসা থেকে দুটি মোটরসাইকেলে বহন করা হচ্ছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঝুঁকি বিবেচনায় মানি এস্কর্ট সেবা পেতে যোগাযোগ করা হয়নি পুলিশের সঙ্গে। এসব জানতে নগদের চার কর্মীকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি।
তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পেরেছি, অনেক সময়ই নয়নের বাসায় টাকা রাখা হতো। মোটরসাইকেলে করেও মাঝে-মধ্যে টাকা বহন করতেন তারা। তবে এত টাকা নয়ন সাহেবের বাসায় আগে কখনো রাখা হয়নি। এত সকালে এভাবে কখনো বহনও করা হয়নি। ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৫ থেকে ৬ জনকে দেখা গেছে। সবার মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা ছিল। তুরাগ দিয়াবাড়ি হয়ে ছিনতাইকারী পালিয়েছে। আমরা তদন্ত করছি। ঘটনাটি ডিটেকশন না হওয়া পর্যন্ত অনুমাননির্ভর কোনো তথ্য দেওয়া ঠিক হবে না।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঢাকা মেট্রো-উত্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি এনায়েত হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিয়মিত কারা টাকা আনা-নেওয়া করতেন? সেদিন কেন অন্যদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল? আবার দিনের টাকা দিনেই আনা-নেওয়া করা হতো। সেদিন কেন বেশ কয়েকদিনের টাকা বহন করা হচ্ছিল তাও আবার মাইক্রোবাসে নয়, মোটরসাইকেলে কেন বহন করা হচ্ছিল— এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে। আমরা বেশ কয়েকজনের নাম পেয়েছি, যারা আগে টাকা আনা-নেওয়া করতেন। পুলিশের সহযোগিতা না নিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা মোটরসাইকেলে বহন করা সন্দেহজনক। আমাদের সন্দেহের তালিকার ৬ থেকে ৭ জন রয়েছে।
ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনাটি নিবিড়ভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। ডিবির একাধিক টিম তদন্তের পাশাপাশি অভিযানে আছে। থানা পুলিশের হেফাজতে থাকা চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
নগদের ডিস্ট্রিবিউটর অফিসের এমডি আব্দুল খালেক নয়ন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা দুজন ব্যবসায়িক পার্টনার। ছিনতাইকৃত টাকাগুলো আমাদেরই। ঈদের কারণে টাকাগুলো জমে গিয়েছিল। খুবই খারাপ লাগছে যে, এত টাকা কখনো আমার বাসায় আগে কখনো রাখিনি। রাখা উচিতও হয়নি। ভুল তো একটা হয়েই গেছে।
কাউকে সন্দেহ করেন কিনা— জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, অফিসের কাউকে সন্দেহ করছি না। অফিসে টাকা আনা-নেওয়াসহ সব দেখভাল করে আরেক পার্টনার তারিকুজ্জামান।
নগদের ডিস্ট্রিবিউটর অফিসের আরেক এমডি তারিকুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নয়নের বাসায় আগে কখনো এত টাকা রাখার রেকর্ড নেই। ঈদের কারণেই এত টাকা জমেছিল, রাখতেও হয়েছিল। আর নয়নের বাসা থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরত্বেই অফিস। সে কারণেই হয়তো ম্যানেজার টাকাগুলো বাইকে করে স্থানান্তর করার নির্দেশ দিয়েছিল। আমি ম্যানেজার রিয়াজুলসহ কোনো সহকর্মীকেই সন্দেহ করতে পারছি না। তারা দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সহকর্মী। পুলিশ, ডিবি, র্যাব, পিবিআই তদন্ত করছে। তারা যখন যা তথ্য চাইছে আমরা সরবরাহ করছি। আমাদের ভুলের সুযোগটাই ছিনতাইকারীরা নিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি আন্তরিকভাবে তদন্তে মনোযোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টাকাগুলো উদ্ধারসহ ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারে সক্ষম হবেন।
জেইউ/এমজে