একদিকে দুর্গম, অন্যদিকে অনেক উঁচু উঁচু পাহাড়। কোনোটির মাটি নরম, আবার কোনোটির মাটি জমাট সিমেন্টের মতো শক্ত। আগে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। সমতলের মতো সড়কের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখে কাজ শুরু করা যায় না। কখনো কখনো পাহাড় কেটে কাজ করে কিছুটা এগোলে দেখা যায় অনেক কষ্টে বানানো কয়েকশ মিটার সড়ক চোখের পলকে ধসে পড়েছে! কোথাও কোথাও পাহাড়ের মাটি একেবারে পাথরের মতো শক্ত। তখন মাটি কাটতে হয় ড্রিল মেশিন দিয়ে। কেবল ২০০ মিটার পাহাড় কেটে সড়কের উপযোগী করতে সময় লাগে এক মাসের বেশি।

মাটির প্রকৃতি বোঝার এই সমস্যার পাশাপাশি আরও অন্তত পাঁচ ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে দুর্গম ও উঁচু পাহাড়ে সড়ক নির্মাণে। এর মধ্যে কোন এলাকা দিয়ে সড়কটি যাবে সেটির পরিকল্পনা করা, নির্মাণ সামগ্রী আনা-নেওয়া, পরিবার-পরিজন ছেড়ে মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে কাজ করতে রাজি থাকা শ্রমিক ম্যানেজ করা, পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের তৎপরতা এড়িয়ে চলা বা মোকাবিলা করা এবং যেটুকু সড়ক নির্মাণ করা হয় তা রক্ষণাবেক্ষণ করা- সবগুলোই চ্যালেঞ্জিং।

সেনা কর্মকর্তাদের ভাষায়, সড়ক নির্মাণের শুরুতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় কোন এলাকা দিয়ে সড়ক যাবে সেটি নির্ধারণ। কারণ, কোনো এলাকায় গিয়ে দেখা যায় ছোট-বড় খাল। আবার কোনো পাহাড়ের ওপর দিয়ে সড়ক নির্মাণ বেশ জটিল।

এসব চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করেন— জানতে চাইলে এক ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি পাহাড়ের কোন অংশ দিয়ে সড়ক যাবে। তারপরও আমরা অনেক সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার হেডম্যান (নির্দিষ্ট পাহাড়ি এলাকার প্রতিনিধি) এবং বাসিন্দাদের সহযোগিতা নিই। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রথমে পায়ে হেঁটে কিছুদূর গিয়ে দেখি। তারপর পাহাড়ি জঙ্গল পরিষ্কার করে কাজ শুরু করি।

সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের পরিচালক কর্নেল মো. দেলোয়ার হোসেন তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, একেক জায়গার চ্যালেঞ্জ একেক রকম। কোনো কোনো এলাকায় খাল বেশি। সেখানে অপেক্ষাকৃত ব্রিজ কম করে ভিন্ন পথ বের করে কাজ করা হয়। কোথাও মাটি একেবারে নরম, আবার কোথাও বালি আবার কোথাও মাটি একেবারে শক্ত। কোথাও নির্মাণ সামগ্রী নিতে সমস্যা এবং কোথাও একেবারে খাড়া পাহাড়, যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করা কঠিন। এসব এলাকায় নির্মাণ খরচ বেড়ে যায়।

উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, একটি ইট সমতলে ১০ টাকা, সেটি সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেক সময় ১০০ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে যায়। সবমিলিয়ে বাজেটের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ এগিয়ে নেওয়াটা বেশ জটিল।

স্থানীয় বাসিন্দা এবং সেনা কর্মকর্তারা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর নানা তৎপরতা সড়ক নির্মাণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের উৎপাতে সন্ধ্যা হলেই কাজ বন্ধ করে দিতে হয়। অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে দিনের বেলা সেনাবাহিনীর টিম সঙ্গে থেকে শ্রমিকদের কাজ করাতে হয়। চাঁদার টাকা না পেলে কোনো কোনো সময় তারা শ্রমিকদের অপহরণ করে। নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে তাদের উদ্ধার করতে হয়।

এসব প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে সড়ক নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে সেনাবাহিনী। সীমান্ত সড়ক নামে প্রকল্পটির আওতাধীন মোট এক হাজার ৩৬ কিলোমিটার সড়কের প্রায় পুরোটাই পাহাড়ি। কোথাও কোথাও দেশের সবচেয়ে উঁচু উঁচু পাহাড়গুলো ছুঁয়ে সড়ক নির্মাণের কাজ করতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে কাজ শেষ হয়েছে ৩১৭ কিলোমিটার।

সেনাবাহিনীর ৩৪ কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের আওতাধীন ২০ ইসিবিতে কর্মরত রয়েছেন মেজর শামীম সরকার। দুর্গম পাহাড়ে সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কাজে তিনি যুক্ত রয়েছেন দুই বছর ধরে। একেবারে কাছ থেকে তদারকি করেছেন এই সড়ক নির্মাণের কর্মযজ্ঞ। তার মতে নান্দনিক সৌন্দর্যের এ সড়ক এত সহজে হয়নি। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এখানে কাজ করতে হয়েছে এবং হচ্ছে।

উদাহরণ টেনে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার মাঝিপাড়া এলাকার একটি পাহাড় ১ হাজার ১০০ ফুট উঁচু। এই এলাকায় ৩০০ মিটার সড়ক বানাতে পাহাড় ড্রেসিং থেকে শুরু করে কার্পেটিং পর্যন্ত প্রায় দুই মাস লেগেছে। সেনাবাহিনী এবং শ্রমিক মিলিয়ে ১৫০ থেকে ২০০ লোক কাজ করেছে। শুধু দিনেই কাজ চলে। একবছরে সমপরিমাণ শ্রমিক নিয়ে প্রায় ১৯ কিলোমিটার সড়ক নির্মিত হয়েছে।

সড়ক নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তারা জানান, দুর্গম সীমান্তে পৌঁছাতে আগে তারা সংযোগ সড়ক নির্মাণ করেন। এভাবে বানানো হয়েছে ৭টি সংযোগ সড়ক। এগুলো দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোর সীমান্তে পৌঁছানোর পর একাধিক ক্যাম্প তৈরি করে কাজ শুরু করেন তারা।

২০ ইসিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আসিফ আহমেদ তানজিল ঢাকা পোস্টকে বলেন, সমতলের চেয়ে এখানে কাজ একেবারে আলাদা। শুরু থেকে শেষ পয়েন্ট পর্যন্ত যাওয়া যায় না। অনেক সময় মাটি নরম হলে ধসে পড়ে। তখন পার্শ্ববর্তী বিকল্প সড়ক শনাক্ত করতে হয়। খরচ বেড়ে যায় কয়েক গুণ। নির্মাণ সামগ্রী দুর্গম এলাকায় আনাও ব্যয়বহুল। নির্মাণের জন্য বিভিন্ন মেশিন আনার সময় দুর্ঘটনা ঘটে। আগেও পাহাড়ি সড়ক নির্মাণ করেছে সেনাবাহিনী। আমাদের অভিজ্ঞতা সমন্বয় করে এবার সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।

এদিকে, দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় সড়ক নির্মিত হওয়ার পেছনে পরিশ্রম করছে সেনাবাহিনীর অনেক সৈনিক ও কর্মকর্তা এবং বেসামরিক শ্রমিকরা। পরিবার-পরিজন দূরে রেখে তারা থাকছেন মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে। যেখানে রয়েছে মৃত্যুঝুঁকিও। ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক। আহত হয়েছেন অনেকে।

২৬ ইসিবিতে কর্মরত সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার প্রিয় রঞ্জন চাকমা বলেন, পাহাড়ে আমাদের প্রতিনিয়ত মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে থাকতে হয়। সহকর্মীদের অনেকে আত্মীয়-স্বজন মারা গেলে শেষবারের মতো দেখতে যেতে পারেন না। তারপরও দেশসেবার লক্ষ্য নিয়ে এই বাহিনীতে ভর্তি হয়েছি। দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাব।

এমআর/এমজে