পার্বত্য চট্টগ্রামের মিয়ানমার ও ভারত সীমান্তে সড়ক নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে সেনাবাহিনী। যেটির মূল অংশ শুরু হয়েছে বান্দরবানের ঘুমধুম থেকে। মিয়ানমারের পাশ দিয়ে সড়কটি এগিয়ে চলেছে মানচিত্র ধরে। মিয়ানমারের পর ভারতের সীমানা ঘেঁষে উঁচু নিচু পাহাড়ি পথ ধরে সড়কটি রাঙ্গামাটি হয়ে খাগড়াছড়ির রামগড়ে গিয়ে শেষ হবে।

দৃষ্টিনন্দন সড়কটির কোনো কোনো অংশ প্রায় ৩ হাজার ১০০ ফুট উঁচু। যেখানে পাহাড় গিয়ে মিশে গেছে মেঘের সঙ্গে। প্রথম পর্যায়ে তিন পার্বত্য জেলা মিলিয়ে সংযোগ সড়কসহ ৩১৭ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের কাজ শেষ হলে শুধু মূল সীমান্ত সড়ক হবে ৮৩০ কিলোমিটারের। তখন এ সড়কটি হবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের ‘মানচিত্র’।

সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে ভারত সীমান্তে ৫৬০ কিলোমিটার এবং মিয়ানমার সীমান্তে রয়েছে ২৭০ কিলোমিটার। বাকি ২০৬ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় সেনাবাহিনীর কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্সের ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড।

প্রথম পর্যায়ে ২০১৮ সালের মার্চে একনেকে তিন পার্বত্য জেলার মোট ৩১৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। ২০২০ সালের শুরুতে সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২৫ সালের জুনে এসে এটির কাজ শেষ হয়। এখন মিয়ানমার সীমান্তে ৮৯ কিলোমিটার, ভারত সীমান্তে ১১৭ কিলোমিটার এবং সংযোগ সড়ক ১১১ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে। সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধীন ১৭, ২০ ও এডহক ২৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন এই কাজ শেষ করেছে।

সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে এ বছর। এ পর্যায়ে ভারত সীমান্তে হবে ১৫৯ কিলোমিটার এবং মিয়ানমার সীমান্তে হবে ১২৯ কিলোমিটার সড়ক। সবশেষ তৃতীয় পর্যায়ে ভারত অংশের বাকি ২৮৪ কিলোমিটার এবং মিয়ানমার অংশের বাকি ৫২ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। তৃতীয় পর্যায়ে সংযোগ সড়ক হবে ৯৫ কিলোমিটার।

সেনাবাহিনীর ৩৪ কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামছুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা ৩০ জুন প্রথম পর্যায়ের কাজ সমাপ্ত করেছি। দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরুর জন্য আমরা সরকার থেকে মৌখিক নির্দেশনা পেয়েছি। এখন ডিপিপি প্রণয়নসহ আনুষঙ্গিক কাজ করা হচ্ছে। আমরা চাই দ্রুত দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরুর জন্য। কারণ আমাদের নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি সব মাঠেই আছে। পরিকল্পনা রয়েছে ২০৩৫ সালে তৃতীয় পর্যায় অর্থাৎ পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করার।

এদিকে সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার পর এটি বিশাল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। দূর পাহাড়ে যারা বঞ্চিত ছিল নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকা ছেড়ে বাড়িঘর করছে সড়কগুলোর পাশে। যোগাযোগ সুবিধার কারণে জীবনমান বাড়ছে পাহাড়িদের। বেড়েছে সামাজিক নিরাপত্তাও। অর্থনৈতিক উন্নতিও হচ্ছে ধীরে ধীরে। উন্মোচন হচ্ছে নতুন নতুন পর্যটন স্পট।

সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের সুবিধাভোগী বাঘাইছড়ি উপজেলার মিলনপুর এলাকার জুমচাষি বাবুল চাকমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে কাছাকাছি মারিশ্যা বাজারে পায়ে হেঁটে যেতে সময় লাগত ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা। এখন মোটরসাইকেলে গেলে ১০ থেকে ১৫ মিনিট লাগে। রাস্তাটি হয়েছে ২০২৪ সালে। একইভাবে আগে রাঙ্গামাটি যেতে পায়ে হাঁটা লাগত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নৌকা আর পায়ে হেঁটে যেতে একদিন লাগত। রাত কাটাতে হতো কোনো আবাসিক হোটেলে। পরদিন আবার একইভাবে ফিরতে হতো। এখন আমরা দিনে দিনে যাতায়াত করতে পারি।

রাঙ্গামাটির জুরাছড়ি উপজেলার ভারত সীমানার একেবারেই কাছে বগাখালী বাজার। এই বাজারে নিজের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রি করেন পুলনাথ চাকমা। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে চাষবাস করলে ভালো দাম পাওয়া যেত না। একসময় আমরা ভারতে গিয়ে বেচতাম, এখন যাওয়া যায় না, একটু জটিল হয়ে গেছে। সেনাবাহিনী রোড করে দেওয়ার পর এখন গাড়িযোগে সরাসরি রাজস্থলী কিংবা জেলা শহরে যাই। এ কারণে এখন ফসলের ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে।

দুর্গম এই এলাকায় সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি তিনটি প্রাইমারি স্কুল স্থাপন করেছে সেনাবাহিনী। আরও একটি নির্মাণের কাজ প্রক্রিয়াধীন। ৩৪ কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের পক্ষ থেকে স্কুলগুলোর সম্পূর্ণ ব্যয় নির্বাহ করা হয়। এর মধ্যে গবাইছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় একটি। যেটি অবস্থিত রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ে। সীমান্ত সংযোগ সড়কের পার্শ্ববর্তী স্কুলটি চালু হয়েছে এ বছর।

মিঠুন বাবু চাকমা নামে এক ব্যক্তি এই স্কুলেন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে রয়েছেন। এটিতে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করার কথা রয়েছে। আপাতত চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত চালু হয়েছে। বর্তমানে এটিতে শিক্ষার্থী রয়েছে ৪২ জন।  

গত ২৮ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রথম শ্রেণিতে পাঠদান করাচ্ছেন নমিতা তঁঞ্চঙ্গ্যা। প্রথম ঘণ্টায় বাংলা পড়াচ্ছেন তিনি।

শিক্ষিকা নমিতা জানান, সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠিত স্কুলটিতে বেশ আগ্রহের সঙ্গে অভিভাবকরা সন্তানদের পাঠাচ্ছেন। তাদেরও আশা সন্তানরা পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হবেন।

৩৪ কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের আওতাধীন ১৭ ইসিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নুর মোহাম্মদ সেলিম বলেন, সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি কেবল একটি অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, এটি এই পাবর্ত্য অঞ্চলের পিছিয়ে থাকা বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনমান পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। পাশাপাশি নানা সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। যাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সহজেই সমতলের বাজারে পাঠাতে পারছে। নারীরাও ঘরে তৈরি পণ্য বাজারে পাঠাতে পারায় তাদের সামাজিক অবস্থানের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।

সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে এ বছর। এ পর্যায়ে ভারত সীমান্তে হবে ১৫৯ কিলোমিটার, মিয়ানমার সীমান্তে হবে ১২৯ কিলোমিটার এবং সংযোগ সড়ক হবে ৫৪ কিলোমিটার। সবশেষ তৃতীয় পর্যায়ে ভারত অংশের বাকি ২৮৪ কিলোমিটার এবং মিয়ানমার অংশের বাকি ৫২ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। তৃতীয় পর্যায়ে সংযোগ সড়ক হবে ৪১ কিলোমিটার।

এমআর/এমজে