হুইলচেয়ারে ছেলের সামনে বাবার নিথর দেহ, যেন এক করুণ চিত্র / ঢাকা পোস্ট

রাত সাড়ে ১২টা। বকশীবাজার মোড় দিয়ে হেঁটে আসছিলেন মুদি দোকানদার জহিরুল হক (৫২)। তার গন্তব্য ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক), যেখানে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছেলে রিহান হক (১৩) চিকিৎসাধীন। সন্তানের চিকিৎসার জন্য পাবনার ঈশ্বরদী থেকে ঢাকায় এসে গত আট মাস ধরে অবস্থান করছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য আর তাদের সহায় হয়নি। সন্তানকে বাঁচাতে এসে উল্টো নিজেই লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন বাবা। রাস্তা পারাপারের সময় মৌমিতা নামের দুটি বাসের মাঝখানে চাপা পড়ে প্রাণ গেছে জহিরুলের।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত ৮ জুন (মঙ্গলবার) দিবাগত রাতে চকবাজার এলাকা থেকে সন্তানের উদ্দেশ্যে ঢাকা মেডিকেলের দিকে হেঁটে আসছিলেন জহিরুল। কিন্তু রাস্তা পারাপারের সময় মৌমিতা নামের দুটি বাসের মাঝখানে চাপা পড়েন তিনি। পরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে এলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

নিহত জহিরুল ইসলামের বড় ছেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিফাত হক। তিনি বলেন, আমার ভাই রিহান ক্যান্সারে আক্রান্ত। আট মাস ধরে ঢামেক হাসপাতালে পড়ে আছে। বাবা তার সেবা করতে করতে নিজের ব্যবসাও ছেড়ে দেন। রাতে এশার নামাজ পড়ে একটু হেঁটে আসছিলেন... কিন্তু দুই বাসের মাঝে চাপা পড়েন। আমরা খুব গরিব। বাবা ছিলেন আমাদের সবকিছু। এখন ভাইয়ের চিকিৎসা কীভাবে চলবে জানি না। আমি লেখাপড়া করছি। এখন লেখাপড়া এবং ভাইয়ের চিকিৎসা একসঙ্গে চালাতে পারব কিনা, কিছুই বুঝতে পারছি না।

ঘাতক বাসের চাপায় প্রাণ হারালেন জহিরুল, অনিশ্চিত ছেলের চিকিৎসা / ঢাকা পোস্ট

কান্নাজড়িত কণ্ঠে রিফাত বলেন, আমাদের মতো গরিব পরিবারে একজনের মৃত্যু মানেই পুরো সংসার অচল হয়ে যাওয়া। আমি রাষ্ট্রপক্ষের কাছে আবেদন করছি, যেন আমার বাবার মৃত্যুর বিচার হয় এবং আমাদের সহায়তা করা হয়।

পরিবারের একাধিক সদস্যের ভাষ্য অনুযায়ী, সন্তানকে চিকিৎসা করাতে এসে সবই শেষ হয়ে গেল রিহানের পরিবারের। এখন রিহানের চিকিৎসার খরচও অনিশ্চিত। বাবা জহিরুল হকের ঈশ্বরদীতে একটি মুদি দোকান ছিল। সন্তানকে চিকিৎসা করানোর জন্য সেই মুদি দোকানটি ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। কিন্তু ছেলের চিকিৎসা শেষ করে যেতে পারলেন না তিনি। উল্টো নিজেই ফিরছেন লাশ হয়ে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানান, বকশীবাজার মোড়ে দুটি যাত্রীবাহী ‘মৌমিতা’ বাস বেপরোয়া গতিতে একটি অপরটিকে ওভারটেক করার সময় মাঝখানে থাকা জহিরুলকে চাপা দেয়। এরপরই রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। পরে আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

নিহত জহিরুল হক (৫২) / সংগৃহীত

নিহতের নিকটাত্মীয় খন্দকার নাজমুল আলম জানান, জহিরুল পাবনার ঈশ্বরদীর বাসিন্দা। তার ছোট ছেলে রিহান হক আট মাস ধরে ক্যান্সারে ভুগছে এবং ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসার জন্য পুরো পরিবার চলে আসে ঢাকায়, কিন্তু সন্তানের চিকিৎসা শেষ করার আগেই নিজেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

পরদিন বুধবার দুপুর আড়াইটায় ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেলের বাগান গেটে নিহত জহিরুল হকের মরদেহ নিয়ে আসা হয়। সেখানে ক্যান্সার আক্রান্ত ছেলে রিহানকে হুইল চেয়ারে করে নিয়ে আসা হয়। তখন কান্নায় ভেঙে পড়ে রিহান।

চকবাজার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাজেদুল ইসলাম জানান, আমরা খবর পেয়ে ঢাকা মেডিকেলে যাই। সেখান থেকে জহিরুল ইসলামের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠাই। পরে তার মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

তিনি আরও জানান, এ ঘটনায় মৌমিতার দুইটি বাস আটক করা হয়েছে এবং ঘাতক দুই বাসের চালককে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।

এসএএ/এমজে