স্বপ্ন পূরণে পরিবারের অভাব-অনটন কিংবা সংকীর্ণতা দমিয়ে রাখতে পারেনি তাদের। কারণ, কারও বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল সন্তান দেশের জন্য জীবন বাজি রাখবে, কেউ ভাই না থাকার অভাব মেটাতে সৈনিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন, আবার কেউ নিজেই দেশমাতৃকার সীমান্ত রক্ষার স্বপ্ন বুনেছেন ছোটবেলা থেকেই। ১০৩তম রিক্রুট ব্যাচের মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে তারা এখন বিজিবির গর্বিত সৈনিক। সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে শুরু হলো এ তরুণদের স্বপ্নের যাত্রা। যেখানে পদে পদে চ্যালেঞ্জ ও জীবনের ঝুঁকি থাকলেও হাসিমুখে তা বরণ করে দীপ্ত শপথ নিয়েছেন তারা।

নবীন সৈনিকরা বলেছেন, শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও রক্ষা করব মাতৃভূমি। সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করব। নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও অর্পিত দায়িত্ব পালন ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করব।

নবীন সৈনিকদের একজন সাইফ মিয়া, ১০৩তম রিক্রুট ব্যাচের মৌলিক প্রশিক্ষণে সর্ববিষয়ে সেরা হয়েছেন। তিনি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরের সাহেদাগোপ গ্রামের কৃষক জামাল মিয়ার ছেলে।

দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে বড় সাইফ মিয়া বলেন, বাবা কৃষি কাজ করে অনেক কষ্ট করে আমাকে পড়ালেখা করিয়েছেন। আমার জন্মের পর থেকেই বাবার স্বপ্ন ছিল বড় হলে আমি যেন সৈনিক হই। আজ বাবার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এখন থেকে দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি রক্ষায় জীবন বাজি রেখে হলেও শত্রুকে প্রতিহত করব। সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে যখন যে নির্দেশনা আসবে তা পালন করব।

শুধু সাইফ মিয়া নন, ১০৩তম রিক্রুট ব্যাচে দীর্ঘ ২৪ সপ্তাহের কঠোর ও কষ্টসাধ্য প্রশিক্ষণ সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করে ৬৫৮ জন পুরুষ ও ৩৬ জন নারী, সর্বমোট ৬৯৪ জন রিক্রুট সমাপনী কুচকাওয়াজের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে সৈনিক জীবনে পদার্পণ করেছেন।

বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বায়তুল ইজ্জতে বিজিবির ঐতিহ্যবাহী প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড কলেজের (বিজিটিসিএন্ডসি) বীর উত্তম মজিবুর রহমান প্যারেড গ্রাউন্ডে এ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। সকাল সাড়ে ৯টায় বিজিবি মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকীকে সশস্ত্র সালাম প্রদানের মধ্যদিয়ে ১০৩তম রিক্রুট ব্যাচের নবীন সৈনিকদের শপথ গ্রহণ ও প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। অভিবাদন গ্রহণ শেষে বিজিবি ডিজি নবীন সৈনিকদের উদ্দেশ্যে দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ দেন।

কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান শেষে প্রশিক্ষণে সর্ববিষয়ে সেরা সাইফ মিয়া বলেন, প্রশিক্ষক এক স্যার বলতেন, তোমার শরীরে হাড্ডি থাকলে মাংসের অভাব হবে না। এই কথাটি আমার মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। প্রতিদিন ট্রেনিং শেষে ক্লান্ত শরীরে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ত, তখন আমি নিজেকে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত হওয়ার বিষয়ে ভাবতাম। বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করেছি।

সাইফ বলেন, এখন আমরা সবাই প্রস্তুত। দেশ ও দেশের মানুষের সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দিতে কোনো ধরনের কুণ্ঠাবোধ নেই।

প্রশিক্ষণ সমাপনীতে পুরুষ সৈনিকদের মধ্যে শারীরিক উৎকর্ষতায় সেরা হয়েছেন সৈনিক মইনুর রহমান, নারী সৈনিকদের মধ্যে শারীরিক উৎকর্ষতায় সেরা হয়েছেন শাপলা খাতুন।

চাঁদনী আক্তার নামে এক সৈনিক জানান, কিশোরগঞ্জের দিকদ্বার এলাকার কৃষক নজরুল ইসলামের মেয়ে তিনি। নুসরাত ও রোজা নামে তার ছোট দুটি বোন রয়েছে। পরিবারে কোনো ভাই না থাকায় ছোটবেলায় তিনি স্বপ্ন দেখেন এমন কিছু করবেন যাতে বাবা-মা ছেলে সন্তান না থাকার আফসোস না করেন। এভাবেই তার মনে সৈনিক হওয়ার ইচ্ছা জাগ্রত হয়। পরে বিজিবিতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেন। ছয় মাসের প্রশিক্ষণ শেষে এখন তিনি বিজিবির গর্বিত সৈনিক।

চাঁদনী বলেন, প্রশিক্ষণের শুরুতে মনে হয়েছে, এই চ্যালেঞ্জে আমি হেরে যাব। কিন্তু প্রশিক্ষকদের সহযোগিতা আর পরিবারের অনুপ্রেরণায় আমি হারিনি। বরং ভয়কে করেছি জয়। এখন কোনো কিছুতেই পিছপা হতে চাই না। নিজের জীবন দিয়ে হলেও দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষায় আমি এখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

সৈনিকদের প্যারেড দেখে আবেগাপ্লুত স্বজনরা

১০৩তম রিক্রুট ব্যাচের সমাপনী কুচকাওয়াজে উপস্থিত ছিলেন নবীন সৈনিকদের স্বজনরাও। সন্তানকে প্যারেড গ্রাউন্ডে দেখে অনেকেই আপ্লুত হয়ে পড়েন। জীবনের ঝুঁকি রয়েছে জেনেও গর্ববোধ করছেন বলে জানিয়েছেন তারা।

নবীন সৈনিক আজিম হোসেনের বাবা মুদি দোকানদার মো. মাসুদ বলেন, আমার ছেলে সব সময় সৈনিক হতে চেয়েছে। আজ ওর স্বপ্ন পূরণ হলো। হায়াত মউত আল্লাহর হাতে, ছেলে দেশের জন্য কাজ করবে এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় গর্বের বিষয়।

পাশেই আঙুলের ইশারায় প্যারেড গ্রাউন্ডে থাকা ছেলেকে দেখিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে সৈনিক পারভেজের বাবা আবদুল মান্নান বলেন, আমার চোখের এই পানি আনন্দের। ছেলের স্বপ্ন পূরণ হতে দেখে চোখে পানি ধরে রাখতে পারছি না।

নবীনদের উদ্দেশ্যে যা বললেন বিজিবির ডিজি

বিজিবির মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে নবীন সৈনিকদের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও অভিবাদন গ্রহণ শেষে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, দেশ মাতৃকার অখণ্ডতা রক্ষায় নবীন সৈনিকেরা প্রয়োজনে তাদের জীবন দেবে তবুও দেশের এক ইঞ্চি মাটি হাতছাড়া হতে দেবে না।

তিনি আরও বলেন, নবীন সৈনিকেরা কখনো দেশবাসীকে হতাশ ও নিরাশ করবে না। তাদের দেওয়া নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাই দেশের মানুষের নির্বিঘ্ন ঘুম নিশ্চিত করবে।

বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী খ্যাত এই বাহিনী বাংলাদেশের ৪ হাজার ৪২৭ কিলোমিটার সুদীর্ঘ সীমান্ত সুরক্ষাসহ সীমান্ত ভূমি ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, মাদক ও অস্ত্রসহ অন্যান্য অবৈধ পণ্যের চোরাচালান প্রতিরোধ, নারী ও শিশু পাচার রোধসহ যেকোনো ধরনের আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমনে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। শুধু তাই নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার ক্ষেত্রেও বিজিবি অত্যন্ত বিশ্বস্ততা ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হচ্ছে।

নবীন সৈনিকদের মনোবল, ভ্রাতৃত্ববোধ, শৃঙ্খলা ও দক্ষতা- বিজিবির এই চারটি মূলমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়ে অর্পিত যেকোনো দায়িত্ব সুশৃঙ্খল ও সুচারুরূপে পালনের নির্দেশ দেন বিজিবি ডিজি।

নবীন নারী সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মহীয়সী নারীদের অংশগ্রহণ, অবদান ও আত্মত্যাগ অবিস্মরণীয়। আজ নারীরা বিভিন্ন অঙ্গনে যথাযথ যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। আজ নবীন নারী সৈনিকরা দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দৃপ্ত শপথ নিয়ে সৈনিক জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।

নবীন নারী সৈনিকরা বিজিবির সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় আরও গতিশীল ভূমিকা রাখাসহ বাহিনীর সুনাম-সুখ্যাতি বৃদ্ধিতে সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করবে বলে বিজিবি মহাপরিচালক আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

উল্লেখ্য, ১০৩তম রিক্রুট ব্যাচের মৌলিক প্রশিক্ষণ গত ২৬ জানুয়ারি শুরু হয়েছিল।

প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে বিজিটিসিএন্ডসির কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গাজী নাহিদুজ্জামানসহ বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।

জেইউ/এমজে