ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম ধাপের সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সংলাপের ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদের’ একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে, যেখানে ৬২টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রস্তাবগুলোকে দেশের সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন, প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কাঠামোকে সময়োপযোগী ও গণমুখী করার সম্ভাব্য রূপরেখা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৩৫টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের ৪৫ অধিবেশনে ১৬৬ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। তার মধ‍্যে ৬২টিতে অধিকাংশ দল ঐকমত্য প্রকাশ করেছে। এ সংক্রান্ত প্রথম ধাপের আলোচনার পর ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৈরি করা একটি খসড়া জুলাই সনদ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে কমিশন৷ 

ঢাকা পোস্টের হাতে আসা ঐকমত‍্য হওয়া ৬২টি প্রস্তাব বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেশিরভাগ প্রস্তাবেই ২৫ থেকে ৩৩টি রাজনৈতিক দলের সম্মতি রয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রথম ধাপে ঐকমত‍্য হওয়া বিষয়গুলো চারটি মোটাদাগে ভাগ করা যায়- সংবিধান সংস্কার, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার এবং দুর্নীতি দমন কাঠামোর সংস্কার।

প্রথম ধাপের সংলাপের পর তৈরি হওয়া প্রস্তাবে দেখা গেছে, সংবিধান সংস্কার কমিশনের আইনসভা গঠনের প্রস্তাবে ৩০টি দল একমত হয়েছে; উচ্চকক্ষের সদস্যদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতায় একমত ২৪টি দল; জাতীয় সংসদে নারী আসনের বিধানে একমত ১৯টি দল; ডেপুটি স্পিকার পদে বিরোধী দল থেকে মনোনয়নে একমত ২৯টি দল।

এ ছাড়া, সংসদের কমিটি ও সদস্যদের অধিকার নির্ধারণের জন্য আইন প্রণয়নে একমত ২৪টি দল; রাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রক্রিয়ায় একমত ২৮টি দল; প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ভাষা বাংলায় একমত ৩০টি দল; বাংলাদেশের নাগরিকদের পরিচয় নিয়ে একমত ৩১টি দল; সংবিধান বিলুপ্তি ও স্থগিতকরণ ইত্যাদি অপরাধের ক্ষেত্রে ২৮টি দল একমত। সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও মর্যাদায় ৩৩টি দল একমত; মৌলিক অধিকারসমূহের তালিকা সম্প্রসারণে ৩১টি দল একমত; আন্তর্জাতিক চুক্তি আইনসভায় অনুমোদনে ২৩টি দল একমত।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের নির্বাচনে ২৮টি দল একমত; স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ২৭টি দল; সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের অধীনে ন্যস্ত করার বিষয়ে ২৭টি দল একমত; স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল সংগ্রহে ২৪টি দল একমত; জেলা সমন্বয় কাউন্সিল প্রতিষ্ঠায় ২৫টি দল একমত; ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলিতে ২৩টি দল একমত হয়েছে। তথ্য অধিকার আইনের আওতায় রাজনৈতিক দলগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ২৪টি দল ঐকমত্যে পৌঁছেছে।

আপিল বিভাগের বিচারক সংখ্যায় ৩০টি দল একমত; সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে ২৬টি দল একমত; সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ কমিশন সংক্রান্ত বিধানে ২৯টি দল একমত; বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় ৩২টি দল একমত; বিচারকদের জন্য পালনীয় আচরণবিধিতে ৩১টি দল একমত; সাবেক বিচারপতিদের জন্য পালনীয় আচরণবিধিতে ২১টি দল একমত।

এ ছাড়া, বিচারকদের চাকরির নিয়ন্ত্রণে ৩১টি দল একমত; সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় ৩১ দল একমত; স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠায় ২৯টি দল একমত; স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস প্রতিষ্ঠায় ৩০টি দল একমত; বিচার বিভাগের জনবল বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ৩২টি দল একমত; জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থাকে অধিদপ্তরে রূপান্তরে ৩০টি দল একমত; বিচারক ও সহায়ক কর্মচারীদের সম্পত্তির বিবরণে ২৮টি দল একমত।

আদালত ব্যবস্থাপনা সংস্কার ও ডিজিটাইজ করার বিষয়ে ৩২টি দল একমত; কতিপয় আইন রহিতকরণ ও সংশোধনে ৩১টি দল একমত; আইনজীবীদের আচরণবিধির ক্ষেত্রে ২৬টি দল একমত; আইনজীবী সমিতি নির্বাচনে দলীয় রাজনীতির প্রভাব বিলোপে ২৫টি দল একমত; বিচারকদের রাজনৈতিক আনুগত্যের ক্ষেত্রে ৩২টি দল একমত হয়েছে।

গণহত্যা ও ভোট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনে ৩২টি দল একমত; স্বাধীন ও স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠনে ২৯টি দল একমত; তথ্য অধিকার আইন ২০০৯-এর সংশোধনে ৩২টি দল একমত; অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট, ১৯২৩ -এর সংশোধনে ২৭টি দল একমত; কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে দুইটি প্রশাসনিক বিভাগ গঠনে ২৮টি দল একমত; স্বতন্ত্র ভূমি আদালত স্থাপনে ২৫টি দল একমত হয়েছে।

সাংবিধানিক ও আইনগত ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে সংবিধান সংশোধনে ৩০টি দল একমত; দুর্নীতিবিরোধী কৌশলপত্র প্রণয়নে ৩০টি দল একমত; বৈধ উৎসবিহীন আয়কে বৈধতা দানের চর্চা বন্ধ করায় ৩২টি দল একমত; রাষ্ট্রীয় ও আইনি ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে সুবিধাভোগী মালিকানা সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে ৩১টি দল একমত; উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি ও অর্থ পাচার রোধে আইন প্রণয়নে ২৯টি দল একমত।

নির্বাচনী অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ২৫টি দল একমত; পরিষেবা খাতের কার্যক্রম ও তথ্য অটোমেশনের বিষয়ে ২৯টি দল একমত; বেসরকারি খাতের দুর্নীতিকে শাস্তির আওতায় আনার ক্ষেত্রে ৩১টি দল একমত; কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্সের বাস্তবায়নে ৩০টি দল একমত; দুদক কমিশনারের সংখ্যা বৃদ্ধি করার বিষয়ে ২৯টি দল একমত; দুর্নীতি দমন কমিশন আইন সংশোধনে ২৬টি দল একমত।

দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনারদের মেয়াদের ক্ষেত্রে ২৫টি দল একমত; দুদক বাছাই কমিটির নাম পরিবর্তনে ৩১টি দল একমত; দুদক বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটির গঠনে ২৫টি দল একমত; বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি কর্তৃক দুদক কমিশনার নিয়োগের অনুসরণীয় পদ্ধতির ক্ষেত্রে ২৭টি দল একমত। এ ছাড়া, বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি কর্তৃক দুদকের কার্যক্রম পর্যালোচনা পদ্ধতির ক্ষেত্রে ৩১টি দল একমত; দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ধারা ৩২ক বিলুপ্ত করার বিষয়ে ২৭টি দল একমত; আয়কর আইন, ২০২৩-এর ধারা ৩০৯-এর সংশোধনে ২৭টি দল একমত; ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপের পক্ষভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ২৩টি দল একমত হয়েছে।

ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রিয়াজ বলেন, প্রথম ধাপের সংলাপে ঐকমত্য হওয়ার একটা তালিকা আপনাদের (রাজনৈতিক দল) কাছে পাঠিয়েছি।

এদিকে চলমান দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে এখন পর্যন্ত জুলাই সনদের ১২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে দলগুলো। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আজ বুধবার পর্যন্ত ঐকমত্য এসেছে- সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান, বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ- (ক) সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ, (খ) উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণার কাঠামো, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, সংবিধান সংশোধন, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ সংক্রান্ত বিধান, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল ও পুলিশ সংস্কার কমিশন।

সংবিধান ও রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কার

৩০টি দল দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা (জাতীয় সংসদ ও সিনেট) গঠনে একমত হয়েছে। নারী আসনের সংখ্যা বাড়িয়ে ১০০ করার বিষয়ে নীতিগত ঐকমত্যে পৌঁছায় ১৯টি দল। ডেপুটি স্পিকার পদে বিরোধী পক্ষ থেকে মনোনয়ন এবং সংসদের কমিটি ও সদস্যদের অধিকার সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে যথাক্রমে ২৯ ও ২৪টি দল সম্মতি দেয়।

রাষ্ট্রপতি অভিশংসন প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রভাষা ও নাগরিক পরিচয় বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের প্রস্তাব আসে, যেখানে বাংলাদেশি পরিচিতি প্রদানে ৩১টি দল একমত। এ ছাড়া, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দিতে বহু-জাতি, বহু-ধর্মীয়, বহু-ভাষী রাষ্ট্র কাঠামোর ধারণা সংবিধানে যুক্ত করার সিদ্ধান্তে ৩৩টি দল একমত হয়।

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে আরও বিকেন্দ্রীকরণ, আর্থিক স্বায়ত্বশাসন এবং সরকারি কর্মকর্তাদের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অধীনস্থ করার প্রস্তাবও গৃহীত হয়। জেলা সমন্বয় কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ের কার্যকর সমন্বয়ের রূপরেখাও নির্ধারণ করা হয়।

এছাড়া, রাজনৈতিক দলসমূহকে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় আনার বিষয়ে ২৪টি দল একমত হয়েছে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, বিচারকদের জন্য পৃথক আচরণবিধি, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস এবং স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠনসহ ৩৭টি সুপারিশের অধিকাংশেই ৩০টির বেশি দল একমত হয়। বিচারকদের সম্পত্তির বিবরণ প্রকাশ, আদালতের ডিজিটাইজেশন এবং আইনজীবী রাজনীতিতে দলীয় প্রভাব রোধে ব্যবস্থাপনার সংস্কার উঠে এসেছে।

এএইচআর/এমজে