চট্টগ্রামের রাউজানে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত এই উপজেলায় খুন হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। এর মধ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে পাঁচজনকে। প্রকাশ্যে ফিল্মি স্টাইলে একাধিক খুনের ঘটনা ঘটলেও সন্ত্রাসীদের লাগাম টানতে পারছে না প্রশাসন। এ নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে পুরো রাউজানে। বেশিরভাগ হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

স্থানীয়রা বলছেন, বিএনপির দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার, বালু মহাল দখল, পারিবারিক বিরোধের জেরে এসব খুনের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত ২৯ জুলাই রাউজানে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনার পর উপজেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে।

২৯ জুলাইয়ের ঘটনার পর চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। এ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন গোলাম আকবর খোন্দকার। একই সঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর পদও স্থগিত করে কেন্দ্র।

সংঘর্ষের বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কবর জিয়ারত কর্মসূচিতে গিয়াস উদ্দিনের নির্দেশে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। হামলায় অনেকে গুরুতর আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় মামলা করা হবে।’

সাম্প্রতিক যত হত্যা

গত ৬ জুলাই যুবদল নেতা মোহাম্মদ সেলিমকে প্রকাশ্যে স্ত্রী-সন্তানের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। একটি সিএনজি চালিত অটোরিকশায় এসে অস্ত্রধারী কয়েকজন যুবক (কেউ কেউ বোরকা পরিহিত) ঠাণ্ডা মাথায় যুবদল নেতাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার একটি সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় জড়িত দুইজনকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। তারা হলেন— চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদ বাহিনীর ক্যাডার রায়হান ও ধামা ইলিয়াস।

এর আগে গত ১৯ এপ্রিল বাগোয়ান ইউনিয়নের গরিব উল্লাহ পাড়ায় মানিক আবদুল্লাহ নামে যুবদলের এক কর্মীকে প্রতিবেশীর বাড়িতে রাতের খাবার খাওয়ার সময় গুলি করে হত্যা করা হয়। চার থেকে পাঁচজন যুবক কিলিং মিশনে অংশ নেয়, যাদের সবার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল।

মানিককে হত্যার দুই দিন পর ২২ এপ্রিল দুপুরে রাউজানে আরেকটি খুনের ঘটনা ঘটে। উপজেলার সদর ইউনিয়নের শমসের নগরের গাজীপাড়ায় মুহাম্মদ ইব্রাহিম (৩০) নামে এক যুবদলকর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। 

গত ১১ মাসে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মোট ১৫ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ১০টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৪টি মামলা হয়েছে রাউজান থানায়। এর মধ্যে ৯টি মামলায় আসামিরা অজ্ঞাত। বাকি মামলাগুলোতে এজাহারভুক্ত অনেক আসামি থাকলেও তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। আবার আসল অপরাধীদের পরিবর্তে এসব মামলায় আওয়ামী লীগের লোকজনকেও আসামি করা হচ্ছে।

বিএনপির দুই গ্রুপে অন্তত অর্ধশত সংঘর্ষ

রাউজানে ৫ আগস্টের পর বিএনপির কেন্দ্রীয় সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি গোলাম আকবর খোন্দকারের অনুসারীরা রাউজানে আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছে। দুই গ্রুপের মধ্যে অন্তত অর্ধশত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৩০টির বেশি মামলা দায়ের হয়েছে থানায়।

সংঘর্ষ ও খাুনাখুনির এসব ঘটনায় পরস্পরকে দায়ী করেন স্থানীয় বিএনপি নেতা গিয়াস কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খোন্দকার। তারা দুজনই বিভিন্ন সময় সংবাদ সম্মেলন করে রাউজানের পরিস্থিতির জন্য একে অপরকে দোষারোপ করেন। দুই নেতার অনুসারীরাও পরিস্থিতি শান্ত করার চেয়ে একে অপরের ওপর দায় চাপানোতে ব্যস্ত রয়েছেন। 

গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিতি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সহ-সভাপতি সাবের সুলতান কাজল বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ৪০টি মামলা, গত ১৭ বছর গ্রামে যেতে পারিনি। কিন্তু আকবর ভাইয়ের (গোলাম আকবর খোন্দকার) অনুসারীরা আরামে ছিল। এখন তারা আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের নিয়ে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করছে। আমরা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। বিএনপির কেউ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত নয়। অনেকে হয়তো বাঁচার জন্য দলীয় পরিচয় ব্যবহার করছে। তাদেরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করুক।’

গোলাম আকবর খোন্দকারের ঘনিষ্ঠ রাউজান উপজেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক জসিম উদ্দিন চৌধুরীকে ফোন করা হলে তিনি মিছিলে ব্যস্ত আছেন বলে জানান। তবে গতকাল বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘গোলাম আকবর খোন্দকার রাউজানে চলাচল করলেই প্রতিপক্ষ শঙ্কিত হয়ে পড়ে। গোলাম আকবর খোন্দকারের জনপ্রিয়তা দেখে তারা চিন্তিত। তাকে প্রতিহত করার জন্য তারা এ ধরনের কাজ করছে। কালকে (গত মঙ্গলবার) তো শেষমেশ গুলিই করল। ভাগ্যক্রমে একটুর জন্য লাগেনি। না হয়, উনি ঘটনাস্থলেই মারা যেতেন। এটা সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত ছিল।’

সক্রিয় শীর্ষ সন্ত্রাসীরা

গত বছরের ৫ আগস্টের পর রাউজানে আবারও সক্রিয় হয়েছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী বিধান বড়ুয়া। তিনি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেন ১৯৯৩ সালে। প্রথমেই খুন করেন পূর্ব গুজরার ইউপি চেয়ারম্যান ও তার প্রথম রাজনৈতিক গুরু আকতার হোসেনকে। পরবর্তী এক দশকে তার বাহিনীর হাতে রাউজানে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর অন্তত এক ডজনেরও বেশি নেতা-কর্মী নিহত হন। এরপর বিএনপি আমলে ক্রসফায়ারের তালিকায় পড়ে গা ঢাকা দেন তিনি। পরে আওয়ামী লীগের আমলে গ্রেপ্তার হন। ৫ আগস্টের পর উপজেলায় আবারও সক্রিয় হয়েছে বিধান বাহিনী।

এদিকে, অভিযোগ রয়েছে, যুবদলকর্মী সেলিম হত্যার মিশনে সরাসরি অংশ নেন ছোট সাজ্জাদ বাহিনীর ক্যাডার রায়হান। চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গায় আরেক সন্ত্রাসী ঢাকাইয়া আকবরকে গুলি করে হত্যার ঘটনায়ও আলোচনায় আসে রায়হানের নাম। এ ছাড়া, নগরীর বাকলিয়ার ডাবল মার্ডারের ঘটনায় এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে রায়হানকে। স্থানীয়রা বলছেন, ৫ আগস্টের পর রাউজানের কদলপুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে রায়হান।

রাউজানের কদলপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ফরহাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘যুবদল নেতা সেলিম ও সিনএনজিচালক দিদার হত্যাসহ কদলপুরে অনেক ঘটনা ঘটেছে। সেলিম হত্যায় অংশ নেওয়া দুই সন্ত্রাসীকে এলাকার মানুষ চিনতে পেরেছে। তবে তাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলে না। এমনকি হত্যার পর মামলা করার সাহস পাচ্ছে না কেউ। অথচ খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরছে। চিন্তা করে দেখেন রাউজানের কী অবস্থা! কতটা ভয়াবহ। সন্ত্রাসীরা বিএনপির দুই শীর্ষ নেতার আশ্রয়ে চলে। তা না হলে গ্রেপ্তার হয় না কেন?’

সন্ত্রাসীরা পাহাড়ে লুকিয়ে যায়

রাউজানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উৎকণ্ঠায় আছে খোদ পুলিশ প্রশাসনও। চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সানতু জানান, তিনি সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় রাউজান থানার ওসিকে আরও কঠোর হতে বলেছিলেন। রাজনৈতিক তদবির উপেক্ষা করে আসামিদের গ্রেপ্তার করতে নির্দেশও দেন তিনি। তবুও সন্ত্রাসীদের লাগাম টানা যায়নি।

জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ভৌগোলিকভাবে রাউজানের অবস্থান পাহাড়-সমতল হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যায় পড়তে হয়। সন্ত্রাসীরা অপকর্ম করে পাহাড়ে লুকিয়ে যায়। রাউজানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। মাঝে প্রায় তিনমাস কোনো খুনের ঘটনা ঘটেনি।’

সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে রাজনৈতিক চাপ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত রাউজানের ঘটনায় কোনো রাজনৈতিক চাপ আমার কাছে আসেনি; এমনকি কোনো নেতা সুপারিশও করেননি। ভবিষ্যতে কেউ সুপারিশ করলেও তোয়াক্কা করব না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যা করা দরকার করব।’

অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অপরাধীর শাস্তি জরুরি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সাবেক সভাপতি ড. মো. শাখাওয়াত হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি ঘটনার পর যদি অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা যায়, তাহলে অপরাধের হার কমে আসে। এতে সমাজে একটি মেসেজ যায় যে, অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে। এর ফলে অপরাধ প্রবণতা কমে যায়। বিপরীতে বিচারহীনতার কারণে অপরাধ বাড়ে। যেমন রাউজানে খুনের ঘটনায় যথাযথ পদক্ষেপ নিলে অপরাধীরা শাস্তির মুখোমুখি হতো। কিন্তু তা হয়নি। এছাড়া অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের স্বাধীনতা দরকার। পুলিশ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে কি না সেটিও দেখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ‘অপরাধ প্রবণতা কমিয়ে আনতে সামাজিক সংগঠন ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সক্রিয় করতে হবে। সমাজে ছোটখাটো সমস্যার সৃষ্টি হয়— এটি স্বাভাবিক বিষয়। আবার এসব থেকে বড় ধরনের সংঘাত তৈরি হতে পারে। তাই সামাজিক সংগঠন বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব সমাধান করা দরকার। আবার পুলিশ চাইলে ক্রাইম জোন চিহ্নিত করে নজরদারি বাড়াতে পারে। যেসব জায়গায় ক্রাইম হয় সেখানে পুলিশের টহল বাড়নো ও সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা যায়।’  

আরএমএন/এমআর/এমজে