পাবনার চাটমোহরের ছাইকোলা ইউনিয়নে প্রাণ ডেইরির একটি গ্রামীণ দুধ সংগ্রহ কেন্দ্রে ডিটারজেন্ট মেশানো দুধ ধরা পড়ার ঘটনাটিকে একটি পরিকল্পিত নাশকতা বলে দাবি করেছে প্রাণ ডেইরি। প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, দীর্ঘদিন ধরে নিম্নমানের দুধ সরবরাহে ব্যর্থ স্থানীয় একটি সংঘবদ্ধ চক্র কৌশলে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

রোববার (১০ আগস্ট) বিকেলে রাজধানীর বাড্ডায় প্রাণ ডেইরির প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ তোলেন প্রাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা।

তিনি বলেন, ছাইকোলা ইউনিয়নের ভিলেজ মিল্ক কালেকশন সেন্টারে স্থানীয় প্রশাসনের অভিযানে ডিটারজেন্ট মেশানো দুধ ধরা পড়ায় আমরাও বিস্মিত হয়েছি। ঘটনার পরপরই আমরা কেন্দ্রটি সাময়িক বন্ধ করে কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্থানীয় একটি দুধ সরবরাহকারী চক্র, যারা দীর্ঘদিন ধরে নিম্নমানের দুধ দিয়ে প্রাণ ডেইরির চেইনে ঢোকার চেষ্টা করেছেন কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছেন, তারা কৌশলে আমাদের তিন কর্মীকে হাত করে ডিটারজেন্ট মিশ্রিত দুধ কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করিয়েছেন। পরবর্তীতে তারা নিজ উদ্যোগে প্রশাসনকে খবর দেয়— যাতে আমাদের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়।

ইলিয়াছ মৃধা জানান, ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত সন্দেহে তিন কর্মীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি চারজন স্থানীয় দুধ সরবরাহকারীর নাম উঠে এসেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রশাসনের অভিযানে ভেজাল দুধ সরবরাহকারীর বাড়ি থেকে সোডা, তেল ও ডিটারজেন্ট পাওয়ার যে ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে, সেটি আমাদের কেন্দ্রের বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আসলে অন্য জায়গার ভিডিও কেটে আমাদের নামে প্রচার করা অত্যন্ত দুঃখজনক।

অতীতেও হামলার শিকার প্রাণের কর্মকর্তা

প্রাণ ডেইরির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা মাকসুদুর রহমান জানান, গুণগতমানের সমস্যা ধরা পড়ায় ছাইকোলার কিছু সরবরাহকারীর কোড স্থায়ীভাবে বাতিল করা হয়েছিল। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা দীর্ঘদিন ধরে প্রাণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছিল।

তিনি বলেন, গত ৭ মার্চ এই একই চক্র প্রাণ ডেইরির একজন কর্মকর্তাকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করে। দুধ না নিলে প্রাণনাশের হুমকি দেয়। এ ঘটনায় স্থানীয় থানায় মামলা হয়। এরপরও তারা হুমকি দিয়ে আসছিল—প্রাণ ডেইরি এখানে কীভাবে কাজ করে তা দেখে নেবে। এবার তারা সেই হুমকি বাস্তবায়ন করেছে।

মাকসুদুর রহমান আরও জানান, বরখাস্ত হওয়া তিন কর্মীকে হাত করেই এই চক্র দুধ সংগ্রহ কেন্দ্রে ডিটারজেন্ট মেশায় এবং প্রাণের নামে অভিযোগ তুলে ধরে প্রশাসনকে অবহিত করে।

কঠোর মান পরীক্ষার প্রক্রিয়া তুলে ধরল প্রাণ

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, প্রাণ দেশের সবচেয়ে বড় দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে চার ধাপে কঠোর মান পরীক্ষার মধ্য দিয়ে দুধ প্রক্রিয়াজাত করে।

তিনি বিস্তারিত তুলে ধরে বলেন, প্রথম ধাপে গ্রামীণ দুধ সংগ্রহ কেন্দ্রে মিল্ক এনালাইজারের মাধ্যমে ফ্যাট, এসএনএফ ও ডেনসিটি টেস্ট হয়। দ্বিতীয় ধাপে মাদার হাবে গিয়ে কেমিক্যাল, সোডা, তেল, ডিটারজেন্ট, সল্ট, ফরমালিন, পিএইচসহ ১৪ ধরনের পরীক্ষা হয়। এরপর নরসিংদীর কারখানায় পৌঁছালে আরেক দফা পরীক্ষা করা হয় এবং প্যাকেটজাত হওয়ার আগে ল্যাব টেস্টে চূড়ান্ত মান নিশ্চিত করা হয়। তাই প্রথম ধাপে ভেজাল ধরা না পড়লেও পরের ধাপগুলোতে তা নিশ্চিতভাবে ধরা পড়ে এবং নষ্ট করা হয়।

তিনি বলেন, পাবনার ঘটনাটি প্রথম ধাপের কেন্দ্রেই ঘটেছে। আমাদের পরীক্ষার প্রক্রিয়াই প্রমাণ করে, ভোক্তার কাছে কোনো ভেজাল দুধ পৌঁছানো সম্ভব নয়।

ভোক্তা মানসিক বিড়ম্বনায় দুঃখ প্রকাশ

কামরুজ্জামান কামাল জানান, নাশকতা ঠেকাতে গ্রামীণ দুধ সংগ্রহ কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, মাঠ পর্যায়ে মনিটরিং জোরদার, খামারি-সরবরাহকারী-আইন প্রয়োগকারী ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সমন্বয়ে সচেতনতা কার্যক্রম এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হবে।

তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, সম্প্রতি ঘটনাটির কারণে আমাদের সারা দেশের অসংখ্য ক্রেতা ও ভোক্তা মানসিক বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। আমরা সবাইকে আশ্বস্ত করছি—প্রাণ দুধ সম্পূর্ণ নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত। পরিবারের সবাই নিশ্চিন্তে প্রাণ দুধ গ্রহণ করুন।

সংবাদ সম্মেলনে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের জনসংযোগ প্রধান তৌহিদুজ্জামান, প্রাণ ডেইরির হেড অব মার্কেটিং সৈয়দ মুস্তায়িন কাদেরসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

টিআই/এমএন