উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রিতা, ব্যয়ের ক্রমবর্ধমান চাপ ও বাস্তবায়নে অদক্ষতা নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকদের এক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কর্মশালায় এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের করণীয় ও সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়ে ওঠে আসবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।

সোমবার (১৮ আগস্ট) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) সকাল ১০টায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উদ্যোগে ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)’র ব্যবস্থাপনায় মন্ত্রিপরিষদ সম্মেলন কক্ষে এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ১০টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত চলবে।

কর্মশালায় উপস্থিত থাকবেন সরকারের সর্বোচ্চ কর্মকর্তারা।

সূত্র জানিয়েছে, এ কর্মশালায় উপস্থিত থাকবেন সরকারের বেশিরভাগ উপদেষ্টা, বিশেষ সহকারী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব, পরিকল্পনা কমিশন এবং পরিকল্পনা ও অর্থ মন্ত্রণায়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। 

কর্মশালাটি যৌথভাবে পরিচালনা করবেন অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।

দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, কর্মশালায় তিনটি মূল লক্ষ্য সামনে রাখা হয়েছে— এর মধ্যে প্রকল্প পরিকল্পনা, অনুমোদন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার বড় সমস্যাগুলো শনাক্ত ও বিশ্লেষণ করা। কেস স্টাডির মাধ্যমে সরকারি খাতের প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা খুঁজে বের করা। নীতিনির্ধারকদের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের সংলাপ তৈরি করে সংস্কার ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের পথ খোঁজা।

সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণ করে। এরপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে অনেকেই নতুন সচিব হিসেবে যোগদান করেন। অনেকেই চুক্তিতে নিয়োগ পান। আবার কেউ কেউ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিত হয়ে দীর্ঘ বছর উপসচিব বা সিনিয়র সহকারী সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। সেইসব কর্মকর্তাদের অনেকেই পদোন্নতি পেয়ে সচিব হয়েছেন। কিন্তু এই সব কর্মকর্তাদের যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব হয়ে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেননি। যে কারণে এই কর্মশালার মাধ্যমে মন্ত্রণালয় ও বিভাগে প্রকল্প প্রণয়নে সেইসব কর্মকর্তাদের সম্যক অভিজ্ঞতা ও ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পর্কে যথাযথ ধারণা অর্জন করা সহায়ক হবে।

সূত্র আরও জানায়, সরকারও মনে করছে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নে সঠিক দিক নির্দেশনামূলক প্রস্তাব তৈরি হবে। যা সংশ্লিষ্ট সবার জন্য অভিজ্ঞতায় কাজে আসবে। প্রকল্প প্রণয়নে ভুলত্রুটি শোধরানো, বা ব্যয় সংকোচন হবে। কারণ সংশ্লিষ্টদের ধারণা রয়েছে, মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রধান অন্তরায়ের মধ্যে রয়েছে সঠিকভাবে অগ্রাধিকার নির্ধারণে জটিলতা। এছাড়াও অনুমোদন প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রিতা, অনুমিত ব্যয়ের তুলনায় খরচ বেড়ে যাওয়া, অদক্ষতা, পর্যাপ্ত তদারকি ও মনিটরিংয়ের ঘাটতি রয়েছে। এসব কারণেই সরকারি ঋণের চাপ বাড়ছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে ঋণের স্থায়িত্ব হুমকির মুখেও পড়ছে।

কার্যপত্র সূত্রে জানা গেছে, কর্মশালায় মূল তিনটি লক্ষ্য থাকছে। বিশেষ করে প্রকল্প পরিকল্পনা, অনুমোদন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার বড় সমস্যাগুলো শনাক্ত ও বিশ্লেষণ করা। সেখানে বিশেষজ্ঞরাও উপস্থিত থাকবেন। সব সচিব, উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীদের উপস্থিতিতে এ ধরনের কর্মশালায় অনেক কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

মন্ত্রিপরিষদ সূত্র বলছে, এ ধরনের কর্মশালা বিগত সরকারগুলোর আমলে অনুষ্ঠিত হয়নি। সবার মতামতের প্রতিফলন হবে। এরপর উচ্চপর্যায়ের সংলাপ তৈরি করে সংস্কার ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণে সহজ হবে।

সরকারের নীতি নির্ধারকরা মনে করছেন, কর্মশালার মাধ্যমে প্রাপ্ত সুপারিশগুলো সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক কাজে আসবে। মেগা মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গতি ফিরে পাবে। শুধু তাই নয়, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, সময়সীমা মেনে কাজ সম্পন্ন এবং ঋণ ব্যবস্থাপনায় একটি টেকসই দিকনির্দেশনা আসবে। যা পরবর্তীতে নির্দেশনা আকারে সরকারের বিভিন্ন সচিবদের কাছে দেওয়া হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সচিব বলেন, ৫ আগস্টের পর বঞ্চিত অনেক কর্মকর্তা সচিব হয়েছেন। যারা সরাসরি উপসচিব থেকে পদোন্নতি পেয়ে সচিব হয়েছেন। তাদের তো নীতিনির্ধারণী হয়ে কাজ করার ন্যূনতম অভিজ্ঞতা নেই। সেক্ষেত্রে শতশত কোটি টাকার প্রকল্প প্রণয়নে তাদের অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকাটাই স্বাভাবিক। অভিজ্ঞতার ঘাটতি হলে প্রকল্পের ত্রুটি বিচ্যুতি ধরা কঠিন হয়। সুতরাং এমন কর্মশালার মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত সুপারিশগুলো অনভিজ্ঞদের জন্য ইতিবাচক হিসেবে কাজে আসবে।

তারা আরও বলেন, প্রত্যেক সরকারের আমলে বছরে এ ধরনের আয়োজন একবার হওয়া উচিত। কর্মশালার মাধ্যমে অর্জিত সুপারিশ সংস্কার ও সমন্বিত পদক্ষেপের জন্য জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তাদের উৎসাহিত করবে। যদিও বাংলাদেশে সামাজিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারপরও প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাছাড়াও কর্মশালার মাধ্যমে শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের একত্রিত করার একটা সহজ পন্থা।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়ন প্রকল্পের সঠিক অগ্রাধিকার নির্ধারণ এবং সময়মতো সমাপ্তি হলে আগামী পাঁচ বছরে অন্তত ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব৷ সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে সরকারি ঋণ ব্যবস্থাপনা আরও টেকসই হবে এবং আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর আস্থাও ফিরে আসবে।

এমএম/এমএন