সরকারি প্রকল্পে অব্যবস্থাপনা
যোগ্য প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে ‘পিডি পুল’ তৈরির সুপারিশ
ছবি- ইনফোগ্রাফ / ঢাকা পোস্ট
২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের এক হাজার ৪৫৪টি প্রকল্পের মধ্যে মোট ৬৬৮টি প্রকল্প পরিদর্শন করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ- আইএমইডি। এসব প্রকল্পের মধ্যে ইন ডেপথ মনিটরিং বা নিবিড় পরিবীক্ষণের আওতায় রয়েছে ৫৫টি প্রকল্প।
আইএমইডির পরিদর্শনে এসব প্রকল্পের নানা রকম অব্যবস্থাপনা উঠে এসেছে। যেমন- ‘অযোগ্য প্রকল্প পরিচালক’ নিয়োগ, আইএমইডির পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা না নেওয়ায় অযাচিত ব্যয়, সময়ক্ষেপণ, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ওপর অধিক মাত্রার নির্ভরশীলতা। এসব সমস্যা সমাধানে বেশকিছু সুপারিশ এসেছে। তার মধ্যে একটি হলো ‘যোগ্য’ প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ। প্রকল্পের যথাযথ বাস্তবায়নে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের নিয়ে পিডি পুল তৈরি করে সেই পুল থেকে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ এসেছে।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উদ্যোগে ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ-ইআরডির ব্যবস্থাপনায় ‘হাই লেভেল ডিজেমিনেশন ওয়ার্কশপ ইন কনটেমপোরারি ইস্যুজ ইন প্রজেক্ট প্ল্যানিং অ্যান্ড ইমপ্লেমেন্টেশন ইন বাংলাদেশ: এ পলিসি মেকিং পারসপেকটিভ’ শীর্ষক এক কর্মশালায় এসব বিষয়ে আলোচনা হয়।
বিজ্ঞাপন
সভায় বেশিরভাগ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, সচিব ও উপদেষ্টারা উপস্থিত ছিলেন। কর্মশালাটি যৌথভাবে পরিচালনা করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এবং পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ।
প্রকল্প প্রণয়ন পর্যায়ে সমস্যা ও সমাধান নিয়ে যেসব বিষয় উঠে এসেছে
সভায় প্রকল্প প্রণয়ন পর্যায়ের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এসব সমস্যার মধ্যে প্রকল্পে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই না করা, অংশীজনদের পরামর্শ না থাকা, ভৌত কাজের যথাযথ আর্কিটেকচারাল এবং ডিজাইন না থাকায় বাস্তবায়ন পর্যায়ে ভেরিয়েশনের উদ্ভব হওয়া, প্রকল্পের সঠিক লজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়ন না করা, প্রকল্প প্রাক্কলনে যৌক্তিক ব্যয় নির্ধারণ করা, পরিবেশগত বিষয় বিবেচনা না করা, প্রকল্পের মাস্টার প্ল্যান অনুসরণ না করা, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ওপর অধিক মাত্রার নির্ভরশীলতা, প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণের ক্ষেত্রে যথাযথ মডেল ব্যবহার না করা, পিইসি বা ডিপিইসি সভায় আইএমইডির প্রতিনিধির মতামত যথাযথভাবে প্রতিফলিত না হওয়ার মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
আরও পড়ুন
সূত্রে জানা গেছে, এসব সমস্যা সমাধানের জন্য পরিপত্র অনুযায়ী দক্ষ ও নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ দ্বারা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, অংশীজন চিহ্নিত করে তাদের সঙ্গে পরামর্শের বিষয়টি আবশ্যক করার সুপারিশ করা হয়েছে। যথাযথভাবে প্রকল্পের লজিকাল ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রকল্পের যৌক্তিক ব্যয় প্রাক্কলন নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে।
প্রতিটি প্রকল্পে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে (ইকোলজি) গুরুত্ব দিয়ে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। মাস্টার প্ল্যান অনুসরণ করে নির্মাণ-সংশ্লিষ্ট ডিজাইন করার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া, প্রতিটি প্রকল্পে সংস্থার সক্ষমতা বিবেচনা করে যুক্তিসংগত প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রকল্পে এমন সুনির্দিষ্ট কম্পোনেন্ট রাখার কথা বলা হয়েছে যার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এর পাশাপাশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ওপর অধিক নির্ভরশীলতা কমানোর কথাও বলা হয়েছে।
সর্বোপরি, পিইসি সভায় বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের প্রতিনিধিদের দেওয়া মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেওয়ার জন্য জোর সুপারিশ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে যেসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়
সভায় প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিয়োগ না করা, একই ব্যক্তির একাধিক প্রকল্পের দায়িত্ব পালন, অভিজ্ঞ পিডি নিয়োগে ব্যর্থতা এবং ঘন ঘন পিডি বদলি। এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য উন্নয়ন প্রকল্পের পিডি নিয়োগ-সংক্রান্ত পরিপত্র কঠোরভাবে অনুসরণ করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ এবং ইউটিলিটি সার্ভিস স্থানান্তরের (শিফটিং) ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার কথাও উঠে এসেছে। এ ছাড়া, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের পরিদর্শন প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
আরও বলা হয়েছে যে, প্রকল্প বাস্তবায়নের একটি বড় সমস্যা হলো প্রকল্পের ওয়ার্ক প্ল্যান এবং প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান সঠিকভাবে প্রণয়ন ও অনুসরণ না করা এবং যথাযথভাবে তা মনিটরিং না করা। এর সমাধানে, ওয়ার্ক প্ল্যান এবং প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান তৈরি করে তার সঠিক বাস্তবায়ন ও নিয়মিত মনিটরিং নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
পাশাপাশি, সময়মতো প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে না পৌঁছানোকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সমস্যার সমাধানে সুপারিশ করা হয়েছে যে, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কমপক্ষে তিন মাস আগেই এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব অবশ্যই আইএমইডির কাছে পাঠাতে হবে।
এসবের পাশাপাশি, প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে নিয়মিত এক্সটার্নাল অডিট নিশ্চিত করার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সময়মতো সিদ্ধান্ত প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও মন্ত্রণালয়কে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জোর দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নোত্তর সমস্যা ও সমাধান
প্রকল্প বাস্তবায়নোত্তর পর্যায়ে বেশ কিছু সমস্যা এবং সেগুলোর সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রথমত, সময়মতো প্রকল্প সমাপ্তি প্রতিবেদন বা পিসিআর বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ আইএমইডিতে দাখিল না করাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সমস্যার সমাধানে বলা হয়েছে, প্রকল্প সমাপ্তির তিন মাসের মধ্যে অবশ্যই আইএমইডিতে পিসিআর পাঠানো নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, প্রকল্পে বিশেষায়িত জনবলের অভাব এবং সময়মতো জনবল নিয়োগ না করাকেও একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে বলা হয়েছে, প্রকল্পের সুফলকে টেকসই করার লক্ষ্যে জনবল কাঠামো অনুমোদন এবং প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের জন্য সংস্থা কর্তৃক সময়মতো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এছাড়া, বাস্তবায়নোত্তর পর্যায়ে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের শর্ত না মানার সমস্যাও চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য, নির্মাণকারী সংস্থাকে ব্যবহারকারী সংস্থার কাছে নির্মাণাধীন স্থাপনা হস্তান্তরের সময় অবশ্যই অকুপেন্সি সনদ প্রদান করতে হবে।
সর্বশেষ, প্রকল্প সমাপ্তির পর যানবাহন সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ করে পরিবহনপুলে জমা না দেওয়া একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ সমস্যার সমাধান হিসেবে বিদ্যমান সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্পের আওতায় যেসব যানবাহন নেওয়া হয়েছে, সেগুলোকে সরকারি পরিবহন পুলে জমা দেওয়া আবশ্যক করা হয়েছে।
আইএমইডির পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের সীমাবদ্ধতা
সভায় প্রকল্প পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নে আইএমইডির বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান সীমাবদ্ধতাগুলো হলো— প্রকল্পের সংখ্যা ও পরিধি বৃদ্ধির তুলনায় আইএমইডির জনবল ও সামর্থ্য সেই অনুপাতে বৃদ্ধি পায়নি। পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কারিগরি সক্ষমতার অভাব রয়েছে। প্রকল্পে ব্যবহৃত উপকরণের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য আইএমইডির নিজস্ব কোনো পরীক্ষাগার নেই।
আরও পড়ুন
প্রকল্প সংক্রান্ত যেসব সুপারিশ উঠে এসেছে
আলোচনা থেকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশও উঠে এসেছে। সেগুলো হলো— প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে পরিকল্পনা বিভাগ কর্তৃক প্রণীত নির্দেশিকা অনুযায়ী সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুতের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ সংক্রান্ত পরিপত্র মেনে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ নিশ্চিত করা। যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি পিডি পুল গঠন করা। এই পুলের কর্মকর্তাদের জন্য আর্থিক ব্যবস্থাপনা, সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। প্রকল্প পরিচালক কর্তৃক প্রস্তুতকৃত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিবিড় তদারকি নিশ্চিত করা এবং আইএমইডির ই-পিআইএমএস সফটওয়্যারে সব প্রকল্পের তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ নিশ্চিত করা।
এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ বলেন, নিয়মকানুন সম্পর্কে সবাইকে জানানো হয়েছে। যার যতটুকু কনফিউশন বা সমস্যা ছিল সেগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। উপদেষ্টাসহ কর্মশালায় অংশ নেওয়া সবাই তাদের মতামত দিয়েছেন। প্রকল্প ব্যবস্থাপনা আরও স্মুথ ও স্মার্ট হোক, এটাই চেয়েছি। এ বিষয়ে যেসব পয়েন্ট উঠে এসেছে সেসব পয়েন্টের ওপর সবাই কথা বলেছেন।
এমএম/এমজে