‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলা : কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সমালোচনার জবাব দিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

সোমবার (১৪ জুন) টিআইবি থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মন্তব্যগুলোকে সাতটি ভাগে ভাগ করে সেগুলোর জবাব দেওয়া হয়েছে। 

গত ৮ জুন করোনায় মারা যাওয়া হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মাহমুদ মনোয়ারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চুয়াল কর্মসূচিতে টিআইবি গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। এরপর ১২ জুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গবেষণার কঠোর সমালোচনা করে কিছু মন্তব্য করেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের বিপরীতে টিআইবির জবাব

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য : ‘টিআইবির রিপোর্টটি আগাগোড়াই ভুল তথ্যসংবলিত’ এবং ‘শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে টিআইবি মনগড়া সমালোচনা করেছে’।

টিআইবির উত্তর : এ গবেষণা সম্পন্ন করার জন্য টিআইবি সামাজিক বিজ্ঞানের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে এবং প্রতিটি তথ্যের সত্যতা একাধিক সূত্র থেকে যাচাই করেছে। 

গবেষণায় প্রত্যক্ষ উৎস হিসেবে সারা দেশের আটটি বিভাগের ৪৩টি জেলা, এবং প্রতিটি জেলা থেকে দ্বৈবচয়িতভাবে এক বা একাধিক (মোট ৫৯টি) টিকাকেন্দ্র নির্বাচন করা হয়েছে। নির্বাচিত কেন্দ্রগুলো হতে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৩০ থেকে ৩৫ জন টিকাগ্রহীতার ‘এক্সিট পোল’ সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে মোট এক হাজার ৩৮৭ জন টিকাগ্রহীতার অভিজ্ঞতা তুলে আনা হয়েছে। 

যে ৫৯টি টিকাকেন্দ্র নির্বাচন করা হয়েছে, সেসব কেন্দ্রের টিকা ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সরাসরি/প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তুলে আনা হয়। টিকা প্রদানের প্রথম ধাপে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যে ২১ ধরনের পেশা/জনগোষ্ঠীকে টিকা প্রদানের জন্য পরিকল্পনা করা হয়। সেই তালিকা হতে দৈবচয়নের ভিত্তিতে সারা দেশের জেলা/উপজেলা পর্যায়ে ১২ ধরনের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মোট ৩১৭টি প্রতিষ্ঠান/দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টিকাগ্রহণ বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এ গবেষণায় জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্য অধিদফতর ও অন্যান্য দফতরের কর্মকর্তা, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, টিকা প্রদানে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ও জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, সাংবাদিকদের কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

এছাড়া পরোক্ষ তথ্য হিসেবে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য এবং গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করা হয়েছে। কাজেই ‘প্রতিবেদনটি ভুল তথ্য সংবলিত’ এবং ‘ঘরে বসে তৈরি করা’ এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।

টেস্টিং নিয়ে মন্ত্রীর বক্তব্য : ‘টিআইবি বলেছে দেশে কোভিড টেস্টিং সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়নি অথচ দেশে কোভিড টেস্টিং কেন্দ্র মাত্র একটি থেকে এখন ৫১০টি করা হয়েছে।’

টিআইবির উত্তর : গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন ও জিন এক্সপার্ট টেস্টের সম্প্রসারণ হলেও আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার এখনো ৩০টি জেলার মধ্যে সীমিত রয়েছে। সর্বমোট ১২৯টি আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগারের মধ্যে ৭৮টি পরীক্ষাগার ঢাকা শহরের মধ্যেই অবস্থিত এবং ৭৭টি বেসরকারি পরীক্ষাগার। ফলে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের দরিদ্র মানুষের নমুনা পরীক্ষার সুযোগ খুব বেশি সম্প্রসারিত হয়নি এবং এখনো দেশের ৩৬টি জেলায় আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার না থাকায় প্রতিবেদন পেতে কোথাও কোথাও এখনও চার থেকে পাঁচ দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

শয্যাসংখ্যা নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য : ‘টিআইবি বলেছে দেশে আইসিইউ বেড (শয্যা) সংখ্যা বাড়েনি।’

টিআইবির উত্তর : টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি আইসিইউ শয্যাগুলোর অধিকাংশ শহরকেন্দ্রিক, বিশেষত ঢাকা শহরকেন্দ্রিক। কোভিড মোকাবিলায় একটি প্রকল্পের আওতায় সারা দেশের প্রতিটি জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে ১০টি করে আইসিইউ শয্যা প্রস্তুত করার পরিকল্পনা করা হলেও এক বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও এখনো তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধির সাথে সাথে সারাদেশে বিশেষত জেলা পর্যায়ে কোভিড চিকিৎসাসেবায় সংকট তৈরি হয়।

স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য : ‘স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির অভিযোগ তোলা অনেকের কাছেই এখন একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। অথচ বেসরকারি হাসপাতালের টেস্টিং জালিয়াতি, একজন ড্রাইভার বা নিম্নপদস্থ কর্মচারীর দুর্নীতি বা বিচ্ছিন্ন কোনো কর্মকর্তার মাধ্যমে অস্বচ্ছতার খবর ছাড়া কেউ স্বাস্থ্য খাতের বড় কোনো দুর্নীতি দেখাতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে যারাই স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম করেছে, তাদেরই আইনের আওতায় এনে বিচার করা হয়েছে।’

টিআইবির উত্তর : করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলা কার্যক্রম নিয়ে টিআইবির গত দুই পর্বের গবেষণাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতের জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ক্রয় ও সরবরাহে অনিয়ম-দুর্নীতি লক্ষ করা গেছে, যা একদিকে প্রয়োজনীয় সরবরাহের ঘাটতি তৈরি করছে। অপরদিকে এসব মানহীন উপকরণ নমুনা পরীক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। মানহীন সুরক্ষা সামগ্রী অনেক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর করোনায় আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর অন্যতম একটি কারণ ছিল। 

বর্তমান সময়েও এই অনিয়ম-দুর্নীতি অব্যাহত রয়েছে, যার কয়েকটি এ গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিগত এক বছরেও কোনো যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট গুটিকয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আইনের আওতায় আনা হয়নি। অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা বলতে কিছু ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের রদবদলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

ভ্যাকসিন ক্রয় নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য : ‘টিআইবি ভারতের সঙ্গে ভ্যাকসিন ক্রয় চুক্তিতে অস্বচ্ছতার কথা বলেছে, যা মোটেও সত্য নয়। ভারতের সঙ্গে চুক্তি থেকে শুরু করে সবকিছু ছিল স্বচ্ছ পানির মতো পরিষ্কার ও উন্মুক্ত। দেশের সব মানুষই জানে, ভারতের সঙ্গে কী কী ছিল চুক্তিতে এবং কেন ভারত চুক্তির অবশিষ্ট টিকা দিতে পারেনি।’

টিআইবির উত্তর : এ গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যৌক্তিক কারণ না দেখিয়ে টিকা আমদানিতে তৃতীয় পক্ষের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তৃতীয় পক্ষের লাভবান হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এই চুক্তির ক্ষেত্রে চুক্তির শর্তাবলী, ক্রয় পদ্ধতি, অগ্রিম প্রদান, তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা, তাদের অন্তর্ভুক্তির কারণ ও তারা কিসের ভিত্তিতে কত টাকা কমিশন পাচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। মানুষ গণমাধ্যম থেকে বিচ্ছিন্নভাবে তথ্য পেয়েছে। এছাড়া এই ক্রয় চুক্তির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বেক্সিমকো ফার্মার কর্তৃপক্ষের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ অনুসারে ক্রয় পরিকল্পনা ও ক্রয় চুক্তি সম্পাদন নোটিশ সিপিটিইউ-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার কথা হলেও তা প্রকাশ করা হয়নি।

আইসোলেশন সেন্টার নিয়ে মন্ত্রীর বক্তব্য : ‘টিআইবি বসুন্ধরা আইসোলেশন সেন্টার প্রসঙ্গে, টিকার প্রায়োরিটি সেট করা বা বিদেশগামী যাত্রীদের সেবা দেওয়ার বিষয়ে যে সমালোচনা করেছে তা আগাগোড়াই মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’

টিআইবির উত্তর : প্রতিটি বিষয়েই গণমাধ্যমে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, এবং গবেষণায় সেসব তথ্য যাচাইসাপেক্ষে উপস্থাপন করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

করোনা নিয়ন্ত্রণে প্রচারণা নিয়ে মন্ত্রীর বক্তব্য: ‘স্বাস্থ্য খাত নিয়ে তারা (টিআইবি) কেবল সমালোচনা করার জন্যই সমালোচনা করেছে, কিন্তু করোনা কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য তারা করেনি। কারণ, তারা করোনা নিয়ন্ত্রণে কোনো প্রচারণা বা ভূমিকাই রাখেনি।’

টিআইবির উত্তর : করোনা কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বিস্তারিত বিশ্লেষণসহ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। টিআইবি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহযোগী ভূমিকা পালনের লক্ষে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনসহ গবেষণা ও অধিপরামর্শমূলক কাজ করে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় করোনা অতিমারি নিয়ন্ত্রণে সুশাসনের ক্ষেত্রে ঘাটতিসমূহ চিহ্নিত করে এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশ তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে টিআইবি এই অতিমারি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সহযোগী ভূমিকাই পালন করছে।

এজন্য টিআইবির প্রতিবেদনকে ‘আগাগোড়া মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ আখ্যায়িত না করে বরং টিআইবি কর্তৃক চিহ্নিত ঘাটতিসমূহকে দূর করা এবং সুপারিশকৃত বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই অতিমারি নিয়ন্ত্রণে অধিকতর কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব বলে সংস্থাটি মনে করে।

আরএম/আরএইচ