দেশে রক্তের মোট চাহিদার প্রায় ১৪ শতাংশই যোগান দিচ্ছে শীর্ষস্থানী সেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। সারাদেশে ৮টি রক্ত কেন্দ্র (ব্লাড ব্যাংক) ছাড়াও ৬৮টি ইউনিটের যুব সদস্যদের মাধ্যমে রক্তদানে সক্ষম জনসাধারণকে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধকরণসহ রক্ত সংগ্রহ কর্মসূচি পরিচালনা করছে সংগঠনটি। এভাবে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি প্রতি বছর প্রায় লক্ষাধিক মানুষকে রক্ত সরবরাহ করে থাকে।

মঙ্গলবার (১৫ জুন) সকালে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ব্লাড প্রোগ্রাম শাখার পরিচালক মো. মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, দেশে রক্তের মোট চাহিদার ১২ থেকে ১৪ শতাংশ রেড ক্রিসেন্ট থেকে সংগ্রহ করে থাকি। আমরা সারাদেশে ৮টি ব্লাড ব্যাংক পরিচালনা করি। প্রতি বছর ৬০ হাজার ব্যাগ রক্ত আমরা সরবরাহ করি। এটি কীভাবে আরও বাড়ানো যায় এবং আমাদের কার্যক্রমকে কীভাবে আরও জোরদার করা যায় সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।

মিজানুর রহমান বলেন, যেখানে আমাদের ব্লাড সেন্টার নেই, সেসব জায়গাগুলোতে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা রক্ত সংগ্রহ করে সরাসরি সদর হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করে থাকে। ৮টি ব্লাড সেন্টারে যদি বছরে ৬০ হাজার ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করা হয়, তাহলে জেলাগুলো মিলিয়ে লক্ষাধিক ব্যাগ রক্ত আমাদের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ম্যানেজ করে দেয়।

তিনি আরও বলেন, বিশেষ করে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীরা রক্তের জন্য আমাদের কাছে বেশি আসে। আমাদের ঢাকা ব্লাড সেন্টারে মাসে গড়ে ৩ হাজার থ্যালাসেমিয়া রোগীকে এই সেবা দিয়ে থাকি।

২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ওই বছরে ৫৮ হাজার ১৭৫ ব্যাগ রক্ত বা রক্ত উপাদান সংগ্রহ এবং ৬৬ হাজার ১০৫ ব্যাগ রক্ত বিতরণ করেছে। কক্সবাজারে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা মিয়ানমারের নাগরিকদের মধ্যে রােগীদের জন্য পরিচালিত ফিল্ড হাসপাতালে প্রয়ােজনীয় রক্ত সরবরাহ করা হয়েছে।

এছাড়াও গত বছরে ইনডাের সার্ভিস, আউটডাের ক্যাম্পেইন ও মােবাইল বাসের মাধ্যমে ২৭১টি রক্ত সংগ্রহের কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়েছে। নতুন করে আউটডাের ক্যাম্পেইন ও মােবাইল বাসের মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহের কার্যক্রমে সক্ষমতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ হিসাবে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট রক্ত কেন্দ্রের জন্য ৩টি মােবাইল বাস কেনা হয়েছে। গ্লোবাল অ্যাডভাইজরি প্যানেলের (GAP) সহযােগিতায় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সােসাইটির রক্ত কর্মসূচির প্রতিটি কেন্দ্রের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কর্মীদের বিদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের অনুদান হিসাবে পাওয়া ১০ কোটি টাকার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি প্রতিটি রক্ত কেন্দ্রে স্থাপন করার জন্য পাঠানাে হয়েছে। রক্ত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বাড়াতে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) সঙ্গে সমঝােতা স্মারক/চুক্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

চিকিৎসকরা জানান, সাধারণত বড় অপারেশনে, বড় দুর্ঘটনায় বেশি রক্তক্ষরণ হলে, সিজারিয়ান অপারেশন, প্রসূতির রক্তক্ষরণে, নবজাতকের রক্তরোগের চিকিৎসায়, হিমোফিলিয়া, ক্যানসার রোগীর চিকিৎসা সহায়তায়, অগ্নিদগ্ধ রোগীর চিকিৎসায়, রক্তস্বল্পতা রোগের চিকিৎসায় রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন হয়। তবে থ্যালাসেমিয়া ও কিডনি ডায়ালাইসিসে নির্দিষ্ট বিরতিতে নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন হয়। এদের শরীরে প্রতিমাসে এক বা একাধিকবার রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হয়।

কারা রক্ত দিতে পারবেন?

# ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সের মধ্যে শারীরিকভাবে সুস্থ নারী ও পুরুষ রক্ত দিতে সক্ষম। এক্ষেত্রে পুরুষের ওজন থাকতে হবে অন্তত ৪৮ কেজি এবং নারীর অন্তত ৪৫ কেজি।

# রক্তদাতাকে অবশ্যই ভাইরাসজনিত রোগ, শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং চর্মরোগ মুক্ত থাকতে হবে। সাধারণত ৯০ দিন পরপর অর্থাৎ তিন মাস পরপর রক্ত দেওয়া যায়।

নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির দফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, রক্তের প্রকৃত চাহিদার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও, দেশে ২০১৯ সালে আনুমানিক ১২ লাখ ইউনিট রক্তের প্রয়োজন ছিল। অন্যদিকে রক্তের যোগান ছিল প্রায় সাড়ে ৮ লাখ ইউনিট। এর ৬০ শতাংশের বেশি রক্তের ব্যবস্থা রোগীর স্বজনরা নিজস্ব মাধ্যমে করে থাকেন। আর ৩০-৩৫ শতাংশ রক্ত আসে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের কাছ থেকে। অবশিষ্ট রক্ত সংগ্রহ করা হয় পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের কাছ থেকে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এক ব্যাগ রক্ত দিতে সময় লাগে মাত্র ১০-১২ মিনিট। এই অল্প সময়ে চাইলেই একজনের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে চাহিদা অনুযায়ী সরাসরি রক্তের যোগান রোগীর স্বজনরা বিভিন্নভাবে পূরণ করে থাকেন। কিন্তু থ্যালাসেমিয়া রোগীরা নিয়মিত রক্ত যোগান দিতে না পেরে একপর্যায়ে মারা যায়। যা প্রকৃত হিসাবে আসে না।

বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের (ডিজিএইচএস) তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে মূলত রক্ত সংগ্রহ করা হয়। এরমধ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো মোট চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ সরবরাহ করে এবং বাকিগুলো সরাসরি রোগীর স্বজনদের অনুদান থেকে আসে। তবে ক্রয় করা রক্তের সরাসরি কোনো হিসেব নেই।

রক্তদান নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (বিআরসিএস), কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, সন্ধানী, বাঁধন এবং পুলিশ ব্লাড ব্যাংকসহ আরও অনেক সংগঠন। বর্তমানে দেশে সরকারি ৩৯০টি এবং লাইসেন্স নিয়ে বেসরকারিভাবে ১০২টি ব্লাড ব্যাংক রক্ত সংগ্রহ ও বিতরণ করছে। এসব কেন্দ্রে হেপাটাইটিস বি-সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া এবং এইডসের স্ক্রিনিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে।

টিআই/জেডএস