রাতের যাত্রা ভোরে শেষ হওয়ার কথা। সেটি যখন ভোর পেরিয়ে সকাল কিংবা সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে যায়, তখন ক্লান্তির আর শেষ থাকে না চালকের। চালকের এই ঘুমচোখ ও ক্লান্ত শরীর দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে এখন ঠিক এমন কারণেই অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে।

রাজধানীর গাবতলী থেকে সায়দাবাদ, নরসিংদী, আশুগঞ্জ, সরাইল, শায়েস্তাগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল হয়ে মৌলভীবাজারের দূরত্ব প্রায় ২১০ কিলোমিটার। একটি বাস এই মহাসড়ক ধরে গড়ে ৪৫–৫০ কিলোমিটার বেগে চললেও সাড়ে ৪ ঘণ্টায় গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু ঢাকা-সিলেট (এন২) মহাসড়কের আশুগঞ্জ থেকে সরাইল বিশ্বরোড মোড় পর্যন্ত মাত্র ১২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে প্রতিটি গাড়ির অন্তত সাড়ে ৫ ঘণ্টা সময় লাগছে। ফলে এই পথে একটি বাস গন্তব্যে পৌঁছাতে ১২–১৩ ঘণ্টা সময় নিচ্ছে।

সম্প্রতি ঢাকা-শ্রীমঙ্গল রুটে একটি বাসের যাত্রী ছিলেন আশরাফুল ইসলাম। এই পুরো পথ অতিক্রম করতে তার প্রায় ১২ ঘণ্টা সময় লেগেছে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, গাবতলী থেকে ছেড়ে আসা শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসে সায়দাবাদ থেকে রাত সাড়ে ১২টায় উঠেছি। বাসটি রাত ২টা ৪৫ মিনিটে আশুগঞ্জের উজান-ভাটি হোটেলে ২০ মিনিটের যাত্রাবিরতি করে। যাত্রাবিরতি শেষে হোটেল থেকে বের হতে হতেই রাত সাড়ে তিনটা বেজে যায়। কারণ হিসেবে জানা যায়, রাস্তার কাজ চলছে। এতে সরাইল বিশ্বরোড মোড় থেকে গাড়ির জট ১২ কিলোমিটার পিছিয়ে উজান-ভাটি হোটেল পর্যন্ত এসে ঠেকেছে।

কোনো এক ফাঁকে আশরাফুল ইসলাম ঘুমিয়ে পড়েন। চালক বাসটি অল্প অল্প করে এগিয়ে নেন। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ঘুম ভাঙে আশরাফুলের। তখন তিনি দেখেন, হোটেল থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার এগিয়েছে বাস। অথচ এই সময়ে তার শ্রীমঙ্গলে পৌঁছানোর কথা ছিল। তিনি বলেন, ভোর সাড়ে ৫টার পর আর ঘুমাতে পারিনি। দুই লেনের ছোট সড়কে শুধু গাড়ির সারি। কোনো গাড়ি সামনের দিকে এগোচ্ছিল না। ৩০ সেকেন্ড এগোলেই ৫ মিনিট বসে থাকতে হতো। এভাবে সরাইল বিশ্বরোড মোড় পার হলাম সকাল ১০টার দিকে। সেখান থেকে শায়েস্তাগঞ্জ মোড় পার হতে আরও দেড় ঘণ্টা সময় লাগে।

তিনি জানান, চালক ঘুম কাটাতে কিছু সময় পরপর পান খাচ্ছিলেন, তবুও ঘুম কাটছিল না। তাকাচ্ছিলেন বড় বড় করে। বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে মহাসড়ক থেকে শ্রীমঙ্গলের দিকে যাওয়ার পথে মিরপুর বাজারের আগে বাম থেকে ডান লেনে যাওয়ার সময় হঠাৎ সামনের চলন্ত ট্রাকের পেছনে ডানদিকে লেগে যায় বাস। সঙ্গে সঙ্গে চলন্ত ট্রাকটি ঘুরে রাস্তার বাইরে চলে যায়। আর বাসের বামপাশ দুমড়ে-মুচড়ে যায়। তবে নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকায় চালক বাসটি দ্রুত শ্রীমঙ্গল নিয়ে আসেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আমরা বাস থেকে বের হই। তিনি বলেন, ‘জানি না ট্রাকে থাকা ব্যক্তিদের কী অবস্থা হয়েছে!’

এমন ঘটনা শুধু একটি নয়। দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানোর কারণে প্রায়ই ক্লান্ত চালকরা এমন দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছেন ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে।

যে ১২ কিলোমিটারে আটকে জনজীবন

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) থেকে জানা গেছে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সওজ। প্রকল্পের আওতায় কাঁচপুর থেকে সিলেট পর্যন্ত ২০৯ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে, যার প্রাক্কলিত ব্যয় ১৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। প্রকল্পে মূল সড়কের দুই পাশে স্থানীয় যানবাহনের জন্য আলাদা সার্ভিস লেনও নির্মাণ করা হবে।

অন্যদিকে, আশুগঞ্জ নদীবন্দর থেকে সরাইল বিশ্বরোড হয়ে আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত অংশটিও চার লেনে উন্নীত করার কাজ ২০১৭ সাল থেকে আলাদাভাবে চলছে। এক দফা সংশোধনের পর ওই প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভারত দিচ্ছে ২ হাজার ৯৮২ কোটি টাকার ঋণ, বাকি ২ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা বহন করবে বাংলাদেশ সরকার। জুন মাসে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত অর্ধেক অগ্রগতি হয়েছে। তিনটি প্যাকেজে বিভক্ত এই প্রকল্পের সবকটি অংশ বাস্তবায়ন করছে ভারতের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।

সওজের দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, করোনার সময় প্রকল্পের কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ভারতীয় ঠিকাদাররা তখন সামান্য কিছু কাজ করলেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। পরে ২০২২ সালে আবার নতুন করে জোরেশোরে কাজ শুরু হয়। স্থানীয়দের সঙ্গে প্রায় তিন শতাধিক ভারতীয় শ্রমিক কাজ করছিলেন।

কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বিদায় নেওয়ার পর পরিস্থিতি বদলে যায়। ভারতীয় কর্মীরা দেশে ফিরে যান, ফলে প্রকল্পের কাজ হঠাৎ থেমে যায়। কিছুদিন পর ঠিকাদাররা ফের কাজে নামলেও বাড়তি খরচ দাবি করে বসে। এ সময় পুরোনো মহাসড়কও ঠিকমতো মেরামত হয়নি। সেখান থেকেই শুরু হয় যানজট, ধুলাবালি ও সাধারণ মানুষের নিত্য ভোগান্তি।

এদিকে বুধবার (৮ অক্টোবর) সকালে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এই পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল গেছেন। তার এই পথ ধরে ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে। তার সফর উপলক্ষ্যে মহাসড়কের ভাঙাচোরা অংশে জোড়াতালি দেওয়া হচ্ছে কয়েকদিন ধরে।

ঢাকা পোস্টের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি মাজহারুল করিম অভি জানিয়েছেন, গত ১ অক্টোবর থেকে সরাইল বিশ্বরোড মোড়ে চলছে হইচই। কেউ ইট ফেলছে, কেউ বালু দিচ্ছে, কেউবা গর্তে বিটুমিন ঢালছে। পাশেই জ্যামে আটকা আছে পণ্যবোঝাই ট্রাক, দূরপাল্লার বাস, প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেল। বাতাসে গরম বিটুমিনের তীব্র গন্ধ ও কাজের চেঁচামেচিতে চারদিক সরগরম। ৬০০–৭০০ মিটার এলাকায় কাজ হচ্ছে। এর মধ্যে গোলচত্বর অংশে ১২ মিটার প্রস্থ ও ১৮৫ মিটার দৈর্ঘ্যে, আর গোলচত্বর থেকে সিলেটমুখী সরাইল কুট্টাপাড়া খেলার মাঠ পর্যন্ত ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০.৩ মিটার প্রস্থে তিন স্তরে ইট ও বালু বিছানোর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ফলে এই পথে থেমে থেমে গাড়ি চলছে। গত কয়েকদিন যাবৎই এই পথে লম্বা জট আছে গাড়ির।

আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত চার লেন মহাসড়ক প্রকল্পের ব্যবস্থাপক শামীম আহমেদ জানান, আশুগঞ্জ থেকে খাঁটিহাতা পর্যন্ত সড়ক অংশে কিছু জটিলতা ছিল। মাঝখানে কাজ কিছুদিন বন্ধও রাখতে হয়েছিল। এখন সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠেছি। সমাধানে ১৬৩ কোটি টাকা নতুন করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দু-তিন দিনের মধ্যেই মূল স্থায়ী কাজ শুরু হবে। কাজ এগিয়ে নিতে এখন আর কোনো বাধা নেই। আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যেই প্রকল্পে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যাবে বলে আমরা আশাবাদী।

বিকল্প চালক নেই, নিরাপত্তা ঝুঁকিতে যাত্রীরা

প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতায় সড়কে গাড়ির জট ও টানা গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনার বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ দায় নিশ্চিতভাবে যারা নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত, ঠিকাদার ও বাস্তবায়নকারী সংস্থা, তাদের নিতে হবে। কারণ, প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হচ্ছে জমি অধিগ্রহণ। এটি জটিল কাজ। প্রকল্পের সময় কমাতে চাইলে, ভোগান্তি কমাতে চাইলে, খরচ কমাতে চাইলে আগে অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। ঠিকাদার কাজ শুরু করলে যেন একটি ‘গ্রিনল্যান্ড’ পায়। কিন্তু জমি অধিগ্রহণে জটিলতার কারণে প্রকল্প এগোয় না। সড়কে বিভিন্ন জায়গায় ঠিকাদার তার নির্মাণ সামগ্রী ও যন্ত্রাংশ রেখে চলে যায়, ভোগান্তি তৈরি করে। ঠিকাদার নিয়োগ হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়, কিন্তু তার সক্ষমতা হয়তো সেরকম নেই।

টানা গাড়ি চালিয়ে চালকের দুর্ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক প্র্যাকটিস অনুযায়ী দূরপাল্লার গণপরিবহনে সবসময় বিকল্প চালক থাকতে হবে। টানা ৪ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর ৩০ মিনিট বিরতি বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাংলাদেশে চালকরা টানা ১২–১৪ ঘণ্টা গাড়ি চালান। এই কাজ ভূতুড়ে চালক ছাড়া সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, দূরপাল্লার বাসে বিকল্প চালক থাকা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। শুধু বিকল্প চালক রাখা নয়, তাদের স্টিয়ারিং নেওয়া ও ছাড়ার সময়ের হিসাব লক ও মনিটরিংও করতে হবে। বিষয়টি অনুমান করে দেখলেই হবে না, বাস্তবভাবে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি করতে হবে। কারণ, দীর্ঘ সময় এক চালক গাড়ি চালানো বিপজ্জনক। আন্তর্জাতিকভাবে দূরপাল্লার যাত্রায় বিকল্প চালক রাখা বাধ্যতামূলক।

মো. হাদিউজ্জামান বলেন, দেশে কিছু পরিবহন মালিক অতিরিক্ত বেতন দিতে চায় না, তাই বিকল্প চালক রাখার দায়িত্ব এড়িয়ে যান। এটি সাধারণত আয় কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে বিকল্প চালক রাখার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং এটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা আবশ্যক।

এমএইচএন/এসএম