পাঁচ দশকের ব্যবধানে বাংলাদেশের কৃষিতে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে। ক্রমাগত কৃষিজমি হ্রাস সত্ত্বেও উৎপাদন বেড়েছে কয়েক গুণ। কৃষির উন্নয়নে বিভিন্ন সময় নতুন নতুন নীতিমালা তৈরি করা হলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন এবং অসংগতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কৃষি সংশ্লিষ্ট নীতিমালাগুলোর মধ্যকার অসংগতির কারণেই বাংলাদেশে টেকসই খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এখন সময় এসেছে এসব নীতিমালা নিয়ে নতুন করে ভাবার। নীতিমালাগুলোর মধ্যে যেসব অসংগতি এবং বৈপরীত্য রয়েছে সেগুলো দূর করে অ্যাগ্রোইকোলজি এবং কৃষি খাদ্য ব্যবস্থার কাঠামোকে কৃষি নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) সকালে রাজধানীর বিডিবিএল ভবনে বণিক বার্তার কনফারেন্স রুমে আয়োজিত ‘জাতীয় কৃষি নীতির বিভিন্ন দিক, এবং কৃষি খাদ্য ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণ’ শীর্ষক পলিসি ডায়ালগে এ তাগিদ দেন বক্তারা। 

অ্যাগ্রোইকোলজি কোয়ালিশন বাংলাদেশ, পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), জার্মানভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়েল্থহাঙ্গারহিলফের (WeltHungerHilfe-WHH) ডায়ালগটি অনুষ্ঠিত হয়। ডায়ালগে মিডিয়া পার্টনার হিসেবে ছিল বণিক বার্তা।

পিকেএসএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুর কাদেরের সভাপতিত্বে ডায়ালগটিতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এস এম সোহরাব উদ্দিন। স্বাগত বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন অ্যাগ্রোইকোলজি কোয়ালিশন বাংলাদেশের আহ্বায়ক এবং ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসীন আলী।

বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন— সার্ক কৃষি কেন্দ্রের পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কম্পোনেন্ট পরিচালক (উপ-সচিব) ড. মোহাম্মদ রাজু আহমেদ, হেইফার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর নরুন নাহার, ওয়েল্থহাঙ্গারহিলফের প্রকল্প প্রধান মামুনুর রশীদ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট মো. মঞ্জুরুল আলম, সিআইআরডিএপির পরিচালক (গবেষণা) ড. গঙ্গা ডি আচার্য্য, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব ইসলাম, ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টের কান্ট্রি প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট মাশিয়াত চৌধুরী, বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সহানোয়ার সাইদ শাহীন। এছাদাও কৃষি মোর্চার জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক মিজানুর রহমান, মানিকগঞ্জের কৃষি মোর্চার প্রতিনিধি জান্নাতুল মৌসুমী, চুয়াডাঙ্গার মোহাম্মদ আলী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। 

স্বাগত বক্তব্যে অ্যাগ্রোইকোলজি কোয়ালিশন বাংলাদেশের আহ্বায়ক এবং ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসীন আলী বলেন, পিকেএসএফ, ডব্লিউএইচএইচসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহযোগিতায় চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, মানিকগঞ্জে জৈব কৃষি কিংবা নিরাপদ কৃষি নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি আমরা। এসব প্রকল্পে আমাদের সুবিধাভোগীর সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। আমরা এগ্রোইকোলজির বাংলা তর্জমা করেছি পরিবেশসম্মত কৃষি। পিকেএসএফ কিংবা অন্য যেসব ডোনারের প্রকল্প আমরা এখন বাস্তবায়ন করছি সেগুলো সরাসরি এগ্রোইকোলজি অ্যাপ্রোচের না হলেও অনেকগুলো উপাদান সেখানে রয়েছে। ওয়েভ ফাউন্ডেশন চুয়াডাঙ্গায় যে গো গ্রিন সেন্টার গড়ে তুলেছে সেখানে পরিবেশসম্মত কৃষির চর্চা হচ্ছে। এখন মানিকগঞ্জে এমন একটি সেন্টার তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। দাতা সংস্থা ডব্লিউএইচএইচের সহযোগিতায় সেখানে এগ্রোইকোলজির একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি।

ডায়ালগে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, সেন্টার ফর সোস্যাল রিসার্চ এর গবেষণা পরিচালক আহমেদ বোরহান। প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি বলেন, মূল চারটি উদ্দেশ্যকে সামনে তিনি এ ডায়ালগের আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যমান কৃষি ব্যবস্থাকে রূপান্তরের মাধ্যমে কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থা কার্যকর করা, পরিবেশসম্মত কৃষির বিকাশ, জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮, জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতি ২০২০, এবং জাতীয় জৈব কৃষি নীতি ২০১৬ এর তুলনামূলক বিশ্লেষণ এবং নীতি নির্ধারক, কৃষক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগী প্রতিষ্ঠান, গবেষক, নাগরিক সমাজসহ সব অংশীদারদের সাথে কার্যকর সহযোগিতা ও সমন্বয় অন্যতম।

তিনি বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ফসল উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য অর্জন হয়েছে। চাল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, ফল ইত্যাদি উৎপাদনে খাদ্য নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বর্তমানে সমন্বিত কৃষিখাতে প্রায় ৪৫% মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এর পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারে মাটি ও পানির দূষণ উল্লেখযোগ্য। জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনেক ক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদন হুমকির মুখে পড়েছে।

সমন্বিত কৃষি খাতে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের হার ৩৯ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। একই সঙ্গে অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের ফলে মানব দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। খাদ্যে ভারী ধাতুর উদ্বেগজনক উপস্থিতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কৃষকরা ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। 

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কৃষি সংশ্লিষ্ট যে সব নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে সেগুলোতে অনেক ভালো ভালো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রত্যেকটি নীতিমালায় কৃষক, টেকসই কৃষি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর কৌশল নিয়েও বলা হয়েছে। তারপরও এসব নীতির মধ্যে রয়েছে দ্বৈততা যেমন; জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮তে টেকসই কৃষি এবং পরিবেশ সম্মত চাষের কথা বলা হলেও, রাসায়নিক সারের ব্যবহারকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতি ২০২০ এ কৃষকদের সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব বা টেকসই চাষাবাদের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া হয়নি। প্রযুক্তি হস্তান্তরের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়।  

কয়েকটি মৌলিক ক্ষেত্রে নীতিগুলোর মধ্যে লক্ষ্য ও বাস্তবায়নে বেশ অসংগতি দেখা যায়, যা টেকসই রূপান্তরের ক্ষেত্রে অন্তরায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, কৃষি নীতির মূল লক্ষ্য দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি ও বাণিজ্যিকীকরণ, যা প্রায়ই একক ফসলের চাষ এবং রাসায়নিক ইনপুটের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা বাড়ায়। এটি জৈব-কৃষি নীতির পরিপন্থি। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এবং সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ ও উপরস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে দূষণ, অপচয় এবং পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা প্রকট হচ্ছে। নীতিগতভাবে জৈব ও রাসায়নিক উভয় সারের কথা বলা হলেও, বাস্তবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ওপর ভর্তুকি ও নির্ভরতা বেশি। এটি 'রাসায়নিক মুক্ত কৃষির লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করছে।

তিনি বলেন, অপরিকল্পিত খাদ্য ব্যবস্থার কারণে ক্রমেই প্রক্রিয়াজাত এবং ফাস্ট ফুড জনপ্রিয় হচ্ছে ফলে খাদ্যের পুষ্টি বৈচিত্র্য ও এতিহ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কৃষি নীতি ২০১৮ অনুসারে (১২.১) কৃষকের ন্যায্য মূল্য এবং ভোক্তার সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, বাজার কাঠামোকে ডিজিটাল করা এবং তথ্য প্রবাহ উন্নত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হলেও দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই বঞ্চিত হচ্ছেন। একই সঙ্গে কৃষি নীতিতে পুষ্টিকর খাদ্যের বিশেষভাবে স্থানীয় ফল ও শস্য উৎপাদনে বৈচিত্র্যকরণকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের সুষম খাদ্যে প্রবেশাধিকার সীমিত। এক কথায়, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, খাদ্য ব্যবস্থা, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও রূপান্তরমূলক পরিবর্তন প্রয়োজন। 

এমন প্রেক্ষাপটে এগ্রোইকোলজি কোয়ালিশন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু সুপারিশ উত্থাপন করেন আহমেদ বোরহান। এর মধ্যে জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮ কে পর্যালোচনা করে নীতিগত দ্বৈততা পরিহার, এগ্রোইকোলজি পলিসি এবং কৃষি খাদ্য ব্যবস্থার কাঠামোকে এই নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা; রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যে জৈব সার খাতে পর্যাপ্ত বিনিযোগ করা; কৃষক-কৃষানি ও যুবদের কৃষক সংগঠন ফার্মার প্রডিউসার অর্গানাইজেশন অথবা ফার্মার প্রডিউসার কোম্পানি গঠনের ওপর জোর দেন তিনি। একই সঙ্গে রূপান্তরমূলক কৃষি চর্চায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সেচ এবং কোল্ড স্টোরেজ খাতে বিনিয়োগের সুপারিশ করেন তিনি। পাশাপাশি এগ্রোইকোলজি চর্চা ত্বরান্বিত করতে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা এবং কৃষক-কৃষাণিদের জন্য পৃথক কোর্স কারিকুলাম উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং এগ্রোইকোলজি চর্চা ত্বরান্বিত করার জন্য একশান রিসার্চ-এর মাধ্যমে এভিডেন্স তৈরির ওপর জোর দেন তিনি।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান, কৃষি নিয়ে আমাদের সম্পদ, চিন্তা এবং উদ্যোগ আছে কিন্তু সমন্বয় নেই। সমন্বয়হীনতার কারণেই আমাদের অনেক ভালো ভালো উদ্যোগ চাপা পড়ে যাচ্ছে। কৃষি এমন একটি সেক্টর যেটাকে সঠিক ভাবে পরিচর্যা করলে পুরো অর্থনীতির চিত্র বদলে যেতে পারে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সীমাবদ্ধতা অনেক। তারপরও সেসব সীমাবদ্ধতাকে পাশ কাটিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি।

তিনি বলেন, আমার মন্ত্রণালয়ে অসংখ্য দপ্তর অধিদপ্তর। এসব দপ্তর অধিদপ্তরে একসময় প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ ছিল। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর যে সব প্রকল্প অযাচিত মনে হয়েছে সেগুলো বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ মেয়াদ শেষে সবগুলো প্রকল্পকে সফল দেখানো হয়। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছি। আমাদের লক্ষ্য ২০৫০ সাল। সে অনুযায়ী আমরা আমাদের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এরই মধ্যে আমরা আমাদের কাজের ১৩টি থিমেটিক জায়গাও নির্ধারণ করে ফেলেছি। এর মধ্যে এগ্রোইকোলজির অনেক উপাদানও রয়েছে। এছাড়া আজকের আলোচনায় জৈব সারে ভর্তুকি, কোল্ড স্টোরেজ ও অ্যাগ্রো প্রসেসিং সেন্টার স্থাপনসহ নানা বিষয় এসেছে। এসব বিষয় নিয়ে এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। 

তিনি বলেন, আমাদের জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে; জমি কমছে- এ বিষয়টি মাথায় রেখেই পুরো পরিকল্পনা সাজিয়েছি আমরা। এখন বাস্তবায়ন করব। এ পর্যায়ে সরকারি, বেসরকারি, এনজিওসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা লাগবে। কারণ সবার সম্মিলিত সহযোগিতা ছাড়া কৃষিকে টেসকই এবং নিরাপদ করা সম্ভব নয়।  

এমএন