দেশে ই-পাসপোর্ট প্রদান পদ্ধতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। পাসপোর্টের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করা হচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) বায়োমেট্রিক তথ্য। পাসপোর্ট করা বা রিনিউ করার প্রক্রিয়ায় পুলিশি যাচাই ‘কার্যত’ বন্ধ হওয়ায় স্বয়ংক্রিয় উপায়ে পরিচয় নিশ্চিত করতে এবং ভুয়া পাসপোর্ট তৈরি ঠেকাতে এ পদ্ধতির দিকে হাঁটছে সরকার।

সম্প্রতি ই-পাসপোর্টের এনরোলমেন্টে আবেদনকারীর এনআইডির ছবি স্ক্রিনে দেখানোর ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এর পাশাপাশি এনআইডিতে থাকা আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলিয়ে চূড়ান্ত যাচাই প্রক্রিয়া যুক্ত করার প্রস্তাব এখন নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে রয়েছে।

এই পদ্ধতি চালু হলে পাসপোর্ট প্রত্যাশীর হাতের আঙুলের ছাপ নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলিয়ে ক্রস চেক করা যাবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য তথ্যও শনাক্ত করা যাবে। 

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এসব বিষয় দ্রুত কার্যকর করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বর্তমানে ই-পাসপোর্টের আবেদন গ্রহণের সময় এনআইডির ডেমোগ্রাফিক তথ্য, যেমন— নাম, জন্মতারিখ, পিতা-মাতার নাম ইত্যাদি ইতোমধ্যে ডিজিটাল পদ্ধতিতে যাচাই করা হয়। এতে জাল পরিচয় দেওয়ার সুযোগ অনেকটাই কমে গেছে। তবে, নিরাপত্তাজনিত কারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর দীর্ঘদিনের দাবি হলো—‘ডেমোগ্রাফিক ম্যাচিং নয়, বায়োমেট্রিক ম্যাচিং বাধ্যতামূলক করা উচিত’। অর্থাৎ আবেদনকারীর আঙুলের ছাপ ও মুখের ছবি মিলিয়ে পরিচয় যাচাই নিশ্চিত করার পক্ষে তারা।

পুলিশি যাচাই বন্ধ থাকায় পরিচয় নিশ্চিতকরণে বড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে। আগে পুলিশ স্থানীয়ভাবে আবেদনকারীর পরিচয়, ঠিকানা, পরিবার ও পেশা সম্পর্কে খোঁজ নিত। এখন এ ব্যবস্থা না থাকায় আবেদনকারী সত্যিই এনআইডিধারী কি না— সেটি নিশ্চিত করতে হবে প্রযুক্তি-নির্ভর পদ্ধতিতে। এনআইডির আঙুলের ছাপ, ছবি ও বায়োমেট্রিক তথ্য এই যাচাইয়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস

ই-পাসপোর্ট বিভাগ সম্প্রতি এনরোলিং অফিসারদের মনিটরে আবেদনকারীর এনআইডিতে সংরক্ষিত ছবি দেখানোর ফিচার সক্রিয় করেছে। এটি ‘প্রথম স্তরের ভিজ্যুয়াল যাচাই’ হিসেবে কাজ করছে, যা মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য সহায়ক হচ্ছে।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, ছবি দেখে মিল যাচাই শতভাগ নির্ভরযোগ্য সিস্টেম নয়। বয়স, আলোর পার্থক্য, ক্যামেরার মান, ওজন পরিবর্তনসহ নানা কারণে ছবিতে পার্থক্য সৃষ্টি হতে পারে। তাই নিরাপদ পরিচয় নিশ্চিত করতে স্বয়ংক্রিয় বায়োমেট্রিক মিল অপরিহার্য। শুধু ছবি প্রদর্শন যথেষ্ট নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাসপোর্ট অধিদপ্তরের এক উপপরিচালক বলেন, মেশিনভিত্তিক বায়োমেট্রিক যাচাই ছাড়া পাসপোর্ট ব্যবস্থায় পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা সম্ভব নয়। এনআইডির ডাটাবেইজ পুরোপুরি ব্যবহার না করলে জাল পরিচয়ে পাসপোর্ট নেওয়ার ঝুঁকি থেকে যাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশি যাচাই বন্ধ থাকায় পরিচয় নিশ্চিতকরণে বড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে। আগে পুলিশ স্থানীয়ভাবে আবেদনকারীর পরিচয়, ঠিকানা, পরিবার ও পেশা সম্পর্কে খোঁজ নিত। এখন এ ব্যবস্থা না থাকায় আবেদনকারী সত্যিই এনআইডিধারী কি না— সেটি নিশ্চিত করতে হবে প্রযুক্তি-নির্ভর পদ্ধতিতে। এনআইডির আঙুলের ছাপ, ছবি ও বায়োমেট্রিক তথ্য এই যাচাইয়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস।

যেভাবে কাজ করবে নতুন প্রস্তাবিত পদ্ধতি

ই-পাসপোর্টের নতুন নিয়মে এনরোলমেন্ট কাউন্টারে আবেদনকারীর আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করা হয়। প্রস্তাবিত পদ্ধতি অনুযায়ী, এই ছাপ সরাসরি এনআইডিতে থাকা আঙুলের ছাপের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মিলিয়ে দেখা হবে। মুখাবয়ব শনাক্তকরণ প্রযুক্তিও (ফেস ভেরিফিকেশন) একইভাবে এনআইডির ছবির সঙ্গে মিলিয়ে কাজ করবে। কোনো অমিল পাওয়া গেলে ‘রেড ফ্ল্যাগ’ হিসেবে কেসটি আলাদা করে ম্যানুয়াল যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হবে।

প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, এতে দুটি বড় সুবিধা হবে— প্রথমত, জাল পরিচয়ে পাসপোর্ট গ্রহণ রোধ হবে। দ্বিতীয়ত, এক ব্যক্তি বিভিন্ন নামে একাধিক পাসপোর্ট নেওয়ার সুযোগ কার্যত বন্ধ হবে। এতে বাংলাদেশের পাসপোর্টের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা মানদণ্ড আরও শক্ত হবে। অনেক দেশ বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন ছাড়া পাসপোর্ট ইস্যু করে না। বাংলাদেশকেও সেখানে যেতে হবে।

নিরাপত্তার পাশাপাশি গোপনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন

বায়োমেট্রিক তথ্য অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাই, নাগরিক অধিকারের সংগঠনগুলো সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিচ্ছে।

সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বলছেন, ডেটা শেয়ারিং ভালো উদ্যোগ হলেও ডাটাবেইজ নিরাপত্তা, ব্যবহারের সীমা, অপব্যবহার রোধে শক্তিশালী আইন ও প্রযুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের বায়োমেট্রিক তথ্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় শেয়ার হওয়া বড় বিষয়। তাই শক্তিশালী ‘ডেটা সিকিউরিটি গাইডলাইন’ ছাড়া ঝুঁকি থাকতে পারে।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ডাটাবেইস শেয়ারিং হবে সম্পূর্ণ এনক্রিপশন প্রযুক্তির মাধ্যমে এবং সরকারি নিরাপত্তা প্রোটোকল অনুসরণ করে। কোনো তথ্য সংরক্ষণ, বিচ্যুতি বা ট্র্যাকিং হবে না— শুধু তাৎক্ষণিক মিল দেখে ফলাফল জানানো হবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পাসপোর্ট ও এনআইডি বিভাগ ইতোমধ্যে প্রযুক্তিগত সংযোগ তৈরির প্রস্তুতি শুরু করেছে। পাইলট প্রকল্প আকারে কয়েকটি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে বায়োমেট্রিক মিল পরীক্ষার প্রস্তাবও রয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, নতুন প্রস্তাবটি কার্যকর হলে ই-পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা ও আন্তর্জাতিক আস্থা আরও বাড়বে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকার নিরাপত্তা মূল্যায়নে এটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই বায়োমেট্রিক মিল–ভিত্তিক যাচাই পদ্ধতি ধাপে ধাপে চালু হতে পারে। তবে, সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত জনবল, শক্তিশালী সার্ভার–নেটওয়ার্ক, ডেটা নিরাপত্তা এবং নাগরিকের আস্থা।

তিনি বলেন, স্বচ্ছ, দ্রুত ও নিরাপদ পাসপোর্ট প্রক্রিয়া কেবল সরকারের সুনামই বাড়াবে না, আন্তর্জাতিক ভ্রমণে বাংলাদেশের অবস্থানও উন্নত করবে। নাগরিকের নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের স্বার্থ ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন এখন আর ‘বিকল্প’ নয়, এটি ‘অপরিহার্য’ হয়ে উঠছে।

সরকারের ব্যয় কমবে, অপরাধী শনাক্তকরণ সহজ হবে

জানতে চাইলে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনকে কেন্দ্র করে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) দীর্ঘদিন ধরে একটা বাণিজ্য করে আসছে। উৎকোচ না পেলে তারা কোনোভাবেই এসব ক্লিয়ারেন্স পাঠাত না। এটি দেশের দীর্ঘদিনের একটি বাজে চর্চা ছিল।

তিনি বলেন, যেহেতু এনআইডি তৈরির সময়ই ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ফেস রিকগনিশনসহ পূর্ণাঙ্গ ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হয়, তাই এনআইডির এই তথ্যগুলো সরাসরি পাসপোর্টের সঙ্গে যুক্ত হলে তা হবে অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ। একই ভেরিফিকেশন এনআইডি ও পাসপোর্টে দুইবার করার কোনো অর্থ নেই। এনআইডি করতে জন্মসনদ ও আঙুলের ছাপ জমা দিতে হয়, একই যাচাই পাসপোর্টে আবার কেন?

ডেটা শেয়ারিংয়ে প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে কি না— জানতে চাইলে জোহা বলেন, কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। বরং এটি সরকারের ব্যয় কমাবে, অপরাধী শনাক্ত করা আরও সহজ হবে এবং মানুষের ভোগান্তি কমবে।

শিশু ও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের বেলায় কী উপায়?

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পরিচয় যাচাইয়ে শিশুদের বাদ দিলে পাসপোর্ট-কেন্দ্রিক পুরো নিরাপত্তা কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, বড়দের পাশাপাশি বাচ্চাদের পরিচয় সঠিকভাবে নিশ্চিত করাটাও এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সেই প্রয়োজন থেকে দেশের প্রতিটি শিশুকে ডিজিটাল জন্মসনদের আওতায় আনা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো একটি ইউনিক আইডেন্টিটি হিসেবে কাজ করবে।

তিনি বলেন, শিশুদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া বা বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষণ করা প্রযুক্তিগতভাবে কঠিন এবং অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয়ও। তাই শিশুদের ১৩ বা ১৭ ডিজিটের অনলাইন জন্মসনদ নম্বরই হবে তাদের মূল পরিচয় শনাক্তকরণ কোড। এই নম্বর অনলাইনে যাচাইযোগ্য হওয়ায় যেকোনো অফিস বা কর্তৃপক্ষ সহজেই নিশ্চিত হতে পারবে শিশুর পরিচয় সঠিক কি না। জন্মসনদভিত্তিক এই শনাক্তকরণ পদ্ধতি চালু হলে শিশুদের পাসপোর্ট অন্যের হাতে যাওয়া বা বেহাত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় পুরোপুরি দূর হবে। পাসপোর্ট আবেদন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বাড়বে এবং জাল জন্মসনদ বা ভুয়া পরিচয়ে পাসপোর্ট নেওয়ার সুযোগ বন্ধ হব।

পাসপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশন শিথিল করে যা বলা হয়েছে

চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘পাসপোর্ট প্রদানের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজনীয়তা শিথিলকরণ’ শিরোনামে একটি পরিপত্র জারি করে সরকার। এতে বলা হয়, পাসপোর্ট সেবা সহজীকরণের লক্ষ্যে সরকার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে—

# নতুন পাসপোর্টের আবেদনের ক্ষেত্রে অনলাইনে যাচাইকৃত জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের ভিত্তিতে আবেদনকারীগণকে পুলিশ ভেরিফিকেশন ব্যতিরেকে পাসপোর্ট প্রদান করতে হবে।

# বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিক এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য পাসপোর্টের নতুন আবেদনের ক্ষেত্রে অনলাইনে থাকা জন্ম নিবন্ধন সনদের তথ্যের ভিত্তিতে আবেদনকারীগণকে পুলিশ ভেরিফিকেশন ব্যতিরেকে পাসপোর্ট প্রদান করতে হবে।

# পাসপোর্ট পুনঃইস্যুর ক্ষেত্রে বিদ্যমান পাসপোর্টের সাথে চাহিত মৌলিক তথ্যের (নিজ নাম, পিতা-মাতার নাম, জন্ম তারিখ, জন্ম স্থান) পরিবর্তন হলে জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রদত্ত তথ্য দিয়ে নতুন পাসপোর্ট ইস্যু করা যাবে।

এমএম/এমজে