‘নারীরা কাজী হতে না পারা সাংবিধানিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’
নারীরাও কাজী হতে পারবেন বলে মনে করেন শ্রমজীবী নারী মৈত্রীর সভাপতি বহ্নিশিখা জামালী ও সাধারণ সম্পাদক রাশিদা বেগম। ‘নারীরা নিকাহ ও রেজিস্ট্রার (কাজী) হতে পারবেন না’ মর্মে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে বিস্ময় প্রকাশ করে তারা বলেছেন, ‘উচ্চ আদালতের দেওয়া এই রায় সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’
সোমবার (১১ জানুয়ারি) দুপুরে এক বিবৃতিতে তারা এ কথা বলেন।
বিজ্ঞাপন
বিবৃতিতে তারা উল্লেখ করেন, ‘সংবিধানের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অধ্যায়ের ২৭ ও ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, নারী হওয়ার কারণে রাষ্ট্র নাগরিকদের প্রতি কোনো প্রকার বৈষম্য প্রদর্শন করবে না। সংবিধানের ৪০ অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে।’
বিবৃতিতে তারা আরও বলেন, ‘হাইকোর্ট প্রদত্ত রায়ে নারীদের শারীরিক সীমাবদ্ধতার যে প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয়েছে তাও যুক্তিযুক্ত নয়। রায়ে বেশিরভাগ বিয়ে মসজিদে সম্পন্ন হওয়ার যে কথা বলা হয়েছে তাও মোটেও তথ্যভিত্তিক নয়।’
বিজ্ঞাপন
তারা বলেন, ‘গত তিন দশক ধরে নারী নেতৃত্বে যদি দেশ ও সরকার চলতে পারে, উচ্চ আদালতের বিচারকার্য থেকে শুরু করে সকল পেশায় নারীরা যদি তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও মেধার পরিচয় দিতে পারেন, তাহলে বিবাহ রেজিস্ট্রার বা কাজীর দায়িত্ব পালনেও নারীদের কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।’
বিবৃতিতে শ্রমজীবী নারী মৈত্রীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘হাইকোর্টের এই রায় নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের পরিপন্থী।’ উচ্চ আদালত নারী অধিকার পরিপন্থী এই রায় পুনঃপর্যালোচনা করবেন এবং কাজী হিসেবে নারীদের দায়িত্ব পালনে সকল বাধা অপসারণে এগিয়ে আসবেন বলে শ্রমজীবী নারী মৈত্রীর পক্ষ থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।
রোববার ‘বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে নারীদের দ্বারা নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়’ মর্মে আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে দিনাজপুরের এক নারীর করা রিট আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট।
আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, নারীরা মাসের একটি নির্দিষ্ট সময় ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফেশন থাকেন। মুসলিম বিবাহ হচ্ছে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং আমাদের দেশে বেশির ভাগ বিয়ের অনুষ্ঠান হয় মসজিদে। ওই সময়ে নারীরা মসজিদে প্রবেশ করতে পারে না এবং তারা নামাজও পড়তে পারে না। সুতারাং বিয়ে যেহেতু একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে নারীদের দিয়ে নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। এই পর্যবেক্ষণ দিয়ে আদালত রুল খারিজ করে দিয়েছেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেন, একজন নারী একজন মুসলিম ম্যারেজ রেজিস্ট্রার হতে হলে কিছু কার্যক্রম করতে হয়। নারী হিসেবে সব জায়গায় যেতে পারবেন কি না। রাত বিরাতে বিয়ের অনুষ্ঠান হতে পারে। সেখানে যেতে পারবেন না। আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, মুসলিম ম্যারেজ রেজিস্ট্রারদের কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয়। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে নারীদের প্রত্যেক মাসে একটি বিশেষ সময় আসে যে সময়টাতে ধর্মীয়ভাবেই নারীরা মসজিদেও যেতে পারেন না, আবার নামাজও পড়তে পারেন না। এরকম সময়ে যদি কারও বিয়ের অনুষ্ঠান হয়, সেখানে তো কোনো নারী যেতে পারবেন না। অন্যান্য পাবলিক অফিসে নারীরা যে কাজ করেন, আর ম্যারেজ রেজিস্ট্রার হিসেবে কার্যক্রমটা আলাদা। বিয়ে শুধু সামাজিক অনুষ্ঠান নয়,এটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানও।
এদিকে শনিবার ফাউন্ডেশন ফর ল’ অ্যান্ড ডেভলপমেন্টের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম। তিনি বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, নারীরা বিমানের পাইলট হচ্ছেন, সশস্ত্র বাহিনীতে নারীরা কাজ করছেন। তাহলে কেন নারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবেন না?
এর আগে গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সামাজিক ও বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে নারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবেন না মর্মে আইন মন্ত্রণালয়ের সিন্ধান্ত বহাল রেখে রায় দেন হাইকোর্ট।
আইনজীবী মো. হুমায়ন কবির জানান, ২০১৪ সালে দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়িয়ার পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে তিনজন নারীর নাম প্রস্তাব করেন উপদেষ্টা কমিটি। তিন সদস্যর এই প্যানেল আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
২০১৪ সালের ১৬ জুন আইন মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে নারীদের দ্বারা নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়’ মর্মে চিঠি দিয়ে তিন সদস্যর প্যানেল বাতিল করেন।
পরে আইন মন্ত্রণালয়ের এই সিন্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন নিকাহ রেজিস্ট্রারের প্যানেলে এক নম্বর ক্রমিকে থাকা আয়েশা সিদ্দিকা।
রিটের শুনানি নিয়ে আদালত আইন মন্ত্রণালয়ের চিঠি কেন বাতিল করা হবে না- এই মর্মে রুল জারি করেছিলেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট রিট আবেদনটি খারিজ করে দেন।
এএইচআর/এইচকে