খোঁড়াখুঁড়ির জন্য সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে মূল সড়ক

যানজটসহ জনগণের ভোগান্তি কমাতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে রাজধানীজুড়ে মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয়। প্রকল্পের কাজের শুরুতেই এলাকাবাসী দুর্ভোগের মুখোমুখি হন। মেট্রোরেলে যানজটের দুর্ভোগ লাঘব হবে— এমন আশায় রাজধানীবাসী হাসি মুখে তা মেনে নেন। কিন্তু নির্মাণকাজের দীর্ঘসূত্রতায় ম্লান হয়ে গেছে সেই হাসি। এখন তা যেন গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে।

রাজধানীর আগারগাঁও থেকে মিরপুর ১২ পর্যন্ত মেট্রোরেলের পাশাপাশি ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের চলমান ধীরগতির কার্যক্রমে অতিষ্ঠ এ অঞ্চলের জনসাধারণ। ‘ভোগান্তি’ কমানোর মেট্রোরেলই এখন যেন তাদের চরম দুর্ভোগের অন্যতম কারণ! সোমবার সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে এমনই অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।

দেখা যায়, মিরপুর ১২ থেকে আগারগাঁও মোড় পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে রাস্তা বন্ধ করে মেট্রোরেলের কর্মযজ্ঞ চলছে। মূল সড়ক বন্ধ থাকায় এ রুটে চলাচলরত পরিবহনগুলো বিভিন্ন গলির রাস্তা ব্যবহার করছে। ফলে গলিপথে গাড়ির চাপ বেশি থাকায় প্রায়ই ছোট-খাট দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটছে।

অন্যদিকে সংকীর্ণ রাস্তা কাটাসহ বিভিন্ন লাইনের কাজ করছে ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন। ভুক্তভোগীরা জানান, দেশের উন্নয়ন হবে, এটা আমাদেরও প্রত্যাশা। কিন্তু কার্যক্রম এত ধীরে হলে তো স্থায়ী বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যাতায়াতের ভোগান্তি আর ধুলাবালির কারণে এখানে কেউ বাসাভাড়া নিতে চাচ্ছেন না। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোও অন্যত্র চলে যাচ্ছে। ফলে আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা।

কাজীপাড়া বাসস্ট্যান্ডের ব্যবসায়ী হাছান মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি উন্নয়নের পক্ষে। তবে উন্নয়নের কার্যক্রম যদি এত দীর্ঘায়িত হয় তাহলে সেটা সবার জন্যই সমস্যা। এখানে আমি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছি। মেট্রোরেলের কাজ শুরুর আগে এ এলাকায় এত ধুলাবালি ছিল না। প্রকল্পের কাজ শুরুর পর ধুলাবালির রাজ্যে পরিণত হয়েছে এলাকাটি। ফলে শারীরিক ও ব্যবসায়িক— উভয় দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

মিরপুর ১২ থেকে আগারগাঁও মোড় পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ করে মেট্রোরেলের কর্মযজ্ঞ চলছে

তিনি বলেন, মেট্রোরেলের খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শেষ হয়েছে। একপাশ বন্ধ করে দেওয়ায় এমনিতেই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে মূল সড়ক। এখন সেই সড়কে নতুন করে ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু হয়েছে। তাও অনেকদিন হলো। কিন্তু ওয়াসা কর্তৃপক্ষের কাজ শেষ হচ্ছে না। শীতের সময় বাতাসে ধুলাবালির উপস্থিতি থাকে বেশি। মাস্ক পরেও কোনো কাজ হয় না। ইদানীং শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়াসহ কাশির সঙ্গে শুধু ময়লা বের হচ্ছে।

শেওড়াপাড়ার শামীম সরণীর মোটরসাইকেল সার্ভিসিং সেন্টারের কর্মী সজীব জানান, সরকারি কাজের জন্য রাস্তা কেটে যাচ্ছেতাই অবস্থা করছে। এখানে প্রতিদিনই দু-তিনটি দুর্ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে রাস্তা কাটার ফলে মোটরসাইকেল ও রিকশা উল্টে মানুষ আহত হচ্ছেন। আর ধুলাবালির জন্য দোকানে অবস্থান করাই কষ্টকর হয়ে পড়ছে। এ কারণে কাস্টমারও ঠিক মতো পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসায় মন্দা চলছে। রাস্তার অবস্থা খারাপ হওয়ায় মোটরসাইকেলসহ যানবাহনের চলাচল আগের থেকে অনেক কমে গেছে।

রিকশাচালক সুমন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এ এলাকায় রিকশা চালাই। ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ির পাশাপাশি শীত আসায় ধুলাবালির পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়েছে। ধুলা নিয়ন্ত্রণে মাঝেমধ্যে পানি ছিটানো হলেও তেমন কাজ হয় না। এ কারণে ভাড়া পেলে অন্য এলাকায় চলে যায়। এখানে রিকশা চালালে জীবন বাঁচানোই কষ্টকর হয়ে পড়বে।

প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার মেট্রোরেলের কাজ চলমান রয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর এ প্যাকেজের কাজের গড় অগ্রগতি ৫৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে কাজের অগ্রগতি ৭৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৪৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম এবং রোলিং স্টক (রেলকোচ) ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ কাজের সমন্বিত অগ্রগতি ৪৩ দশমিক ৮২ শতাংশ।

গলিপথে গাড়ির চাপ বেশি থাকায় প্রায়ই ছোট-খাট দুর্ঘটনা ঘটছে

মিরপুর-১২ থেকে আগারগাঁও অংশে প্রকল্পের দায়িত্বরত কর্মকর্তা আফতাব মাহমুদ গালিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, ধুলাবালির বিষয়সহ মেট্রোরেলের অন্যান্য সব কার্যক্রম নিয়ে আমাদের এমডি স্যার কথা বলেন। প্রতি মাসে একবার তিনি টেলিভিশন-পত্রিকার সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। আপনার কিছু জানার থাকলে আগামী ব্রিফিংয়ে এসে জানাতে পারেন।

ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ির বিষয়ে সংস্থাটির নির্বাহী প্রকৌশলী রামেশ্বর বলেন, আমরা এখনও এ রুটে কাজ শুরু করিনি। তবে কাজ করার জন্য মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছি। মেট্রোরেল অনুমতি না দিলে কাজ শুরু করতে পারব না। তাহলে কারা নতুন করে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করছে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সম্ভবত মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ অথবা সিটি করপোরেশন করছে। তারাই বিষয়টি ভালো বলতে পারবে।

প্রসঙ্গত, ঢাকার ব্যস্ততম সড়কগুলোর অন্যতম মিরপুর-মতিঝিল সড়ক। এ অংশে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। ২০২৪ সালে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা। ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পে মোট ব্যয় হচ্ছে ২২ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে মতিঝিলে যেতে লাগবে ৩৮ মিনিট। ঘণ্টায় দুই দিক থেকে ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে এর কোচগুলো।

সংশ্লিষ্টরা জানান, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত স্টেশন হবে ১৬টি। শুরুতে ২৪টি ট্রেন দিয়ে মেট্রোরেল চালু হবে। প্রতিটি ট্রেনে প্রাথমিকভাবে ছয়টি করে বগি থাকবে। পরে তা আটটিতে উন্নীত করার পরিকল্পনা আছে। প্রাথমিক হিসাবে, শুরুতে দিনে চার লাখ ৮৩ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে মেট্রোরেল। ২০৩৫ সালে যাত্রীসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১৮ লাখের বেশি।

এসআর/এমএআর/এমএইচএস