জীবনযুদ্ধে হার না মানা এক মাসুদ রানার গল্প
শারীরিক অক্ষমতা বা প্রতিবন্ধিতা কখনোই মানুষের সফলতায় বাঁধার কারণ হতে পারে না। অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর সাহসী মনোবলের কাছে তুচ্ছ সব জীর্ণতা। যুগে যুগে অসংখ্য মানুষ শারীরিক নানা অসঙ্গতি নিয়ে সফলতার ইতিহাস রচনা করেছেন। তেমনি জীবন-যুদ্ধের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে শারীরিক অক্ষমতাকে জয় করে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তরুণ মাসুদ রানা ৷ চলাফেরার স্বাভাবিক ক্ষমতা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করলেও থেমে থাকেননি জীবন চলার সংগ্রামে ৷ শত প্রতিকূল পরিবেশ আর সমস্যার পথ পাড়ি দিয়ে আজ তিনি প্রতিষ্ঠিত।
চলাফেরার একমাত্র অবলম্বন হুইল চেয়ারে বসেই শেষ করেছেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বর্তমানে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন ৷ শত চড়াই উৎরাই পেরিয়ে জীবন সংগ্রামে স্বপ্ন পূরণের সেসব গল্প শুনিয়েছেন স্বপ্নবাজ তরুণ মাসুদ রানা।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্টের পাঠকদের জন্য অনুপ্রেরণার সেসব গল্প তুলে ধরেছেন প্রতিবেদক হাসান তামিম।
‘বেশ ভালোই চলছিল মাসুদ রানা জীবনকাল ৷ বড় স্বপ্ন নিয়ে গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন লক্ষ্মীপুর দালাল বাজার ডিগ্রি কলেজে ৷ সেখানে তিন মাস না পেরুতেই জীবনে নেমে আসে কালো অধ্যায়। ২০০৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছোট ভাইকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনার মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে হারিয়ে ফেলেন উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা।
বিজ্ঞাপন
এক বছর নানা চিকিৎসা চললেও শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি কোনো চেষ্টা। শেষে হুইল চেয়ারে বসেই উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাসে ফেরেন। ২০১০ সালে এইচএসসি পাস করেন। উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে পেরিয়ে ঢাকা আসেন। ঠাঁই হয় খালার বাসায় ৷ ভর্তি হন রাজধানীর তেজগাঁও সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ৷ সেখান থেকে স্নাতক শেষে ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেন ২০১৯ সালে ৷ জীবনের এই দীর্ঘ সময় পাড়ি দেওয়া এতটা সহজ ছিল না। সব সময় হুইল চেয়ারে বসেই ক্লাস-পরীক্ষাসহ সার্বিক কার্যক্রম শেষ করতে হতো।
তবে বেশ চিন্তায় ছিলেন ভবিষ্যৎ কর্মজীবন নিয়ে। তাই স্নাতকোত্তর শেষে হওয়ার আগেই যোগ দেন খণ্ডকালীন চাকরিতে। এরপর স্নাতকোত্তর শেষে স্থায়ীভাবে চাকরি শুরু করেন। চাকরির শুরুতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাস্টমার কেয়ার এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগ দিলেও নিজ যোগ্যতা আর কর্মনিষ্ঠার ফলে বর্তমানে কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার পদে কাজ করছেন ৷ বয়স কম থাকায় জেনারেল ম্যানেজারে পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন না ৷ তবে তার প্রত্যাশা আগামী বছর কোম্পানিটির জেনারেল ম্যানেজার পদে পদোন্নতি পাবেন।
ব্যক্তিজীবনে মাসুদ রানার পরিবারে মা, স্ত্রী, বড় ভাই-ভাবী এবং ছোট ভাই রয়েছেন। ২০১৬ সালে পরিচয়ের পর গত বছরের নভেম্বরে স্ত্রী ফারহানা ইয়াসমিন বৃষ্টিকে বিয়ে করেন তিনি ৷ স্ত্রী পেশায় একজন ব্যবসায়ী। জানান নিজের এ অবস্থানে আসার পেছনে তার স্ত্রী দিনের পর দিন পরিশ্রম করেছেন ৷ সাহস দিয়ে পাশে থেকেছেন। বাস্তবতা বুঝতে শিখিয়েছেন।
পরিবারের কাছে নিজেকে কখনও বোঝা মনে হয়েছে কি-না? এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বলেন, ‘আমি আসলে খুবই ভাগ্যবান যে সবসময় পরিবার আমার পাশে ছিল। বড় ভাই মানসিক, অর্থনৈতিক সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন। পরিবার থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে সবসময় উৎসাহ দিয়েছে ৷ বড় ভাই উৎসাহ দিতেন অর্থ উপার্জনের জন্য নয় বরং নিজের জন্য পড়ালেখা করতে।’
তবে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পরিবারের বাইরে সমাজে এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে তার ৷ এমন একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ২০১০ সালে এইচএসসি পরীক্ষার আগে যখন টেস্ট পরীক্ষায় অংশ নিতে গেলাম। আমার পরীক্ষার সিট যেন দ্বিতীয় তলায় না পড়ে এজন্য পিয়নকে ঘুষ দিতে হলো, কারণ হুইল চেয়ারে বসে আমার পক্ষে দ্বিতীয় তলায় ওঠা সম্ভব না। পরীক্ষার দিন কলেজে গিয়ে দেখলাম আমার সিট দ্বিতীয় তলায় পড়েছে। পরীক্ষা শুরুর প্রায় পঁচিশ মিনিট পর ওই পিয়ন উঁচু একটি টেবিল নিয়ে এলেন। হুইল চেয়ারে বসে অত উঁচু টেবিলে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব না৷ পরে নিচ তলায় বারান্দায় বসে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আর সেটি ছিল মেয়েদের পরীক্ষার হলের পাশেই ৷ ওই সময়ে একটা সতের বছরের ছেলের জন্য এটা বেশ কঠিন ৷ এমন আরও অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা পার করেছি আমি।
চলাফেরায় অক্ষম হওয়ায় কলেজে গিয়ে ক্লাস করতে পারেননি ৷ পড়ালেখা যা করার বাসায় বসেই সেরেছেন। কোনো দিক নির্দেশনা আর শিক্ষকদের সহযোগিতা ছাড়াই নিজের প্রচেষ্টায় এগিয়েছেন এতদূর ৷ ঢাকায় আসার পর প্রথমদিকে বাইরে বের হতেন না ৷ পরে মামা, খালাতো ভাইদের সহযোগিতায় কলেজের বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া। তারপর থেকেই ধীরে ধীরে বাইরের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
মাসুদ রানা বলেন, একজন সাধারণ মানুষকে স্বাভাবিকভাবে যে ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তার থেকে কয়েকশ গুণ বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় শারীরিকভাবে অক্ষম কোনো ব্যক্তিকে ৷ নিজেকে এমন কোথাও নিয়ে দাঁড় করানো উচিত যেখান থেকে সব সমস্যাকে বুড়ো আঙুল দেখানো যায়। আর এটার পরিশ্রম অব্যাহত রাখতে হয়।
এছাড়াও পরনির্ভরশীল না হয়ে যদি নিজের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ বাড়ানো যায় তাহলে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিজেকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। সবশেষ মাসুদ বললেন, ‘পা দুটো কাজ না করলেও হাত ও মাথা তো ঠিকই কাজ করছে। এটুকু নিয়েই সামনের দিনগুলো কাটিয়ে দিতে চাই।’
আরএইচটি/এসএম