ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে করপোরেশনের ভূমিকা নিয়ে নগরবাসীর প্রশ্ন
চলতি বছরের আগস্টে দেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। আগস্টের ২৭ দিনে ৬ হাজার ৬৪৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্য মতে, গত জুলাই মাসেই ২ হাজার ২৮৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। আর এদের ৯৯ শতাংশই ঢাকা জেলার।
নগরবাসী বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হলেও শুধুমাত্র খবরেই সিটি করপোরেশনের অভিযান পরিচালনা দেখা গেছে। বাস্তবে নিয়মিতভাবে কখনই মশক নিধন কর্মীদের দেখেননি তারা।
বিজ্ঞাপন
বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় মিরপুরের কাজী পাড়া এলাকার বাসিন্দা মাসুম আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের কাজটা আসলে কী? বর্ষার সময় আমাদের পোহাতে হয় জলাবদ্ধতার ভোগান্তি, আর অন্য সময় মশা। ডেঙ্গুর ভয়ে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই মশারি টাঙিয়ে বাসায় থাকতে হয়। ডেঙ্গু রোগী এতো হওয়ার পিছনে এটি নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতাই কারণ। সারা বছর যদি সংশ্লিষ্টরা মশক নিধনে উদ্যোগী থাকতেন, তাহলে এতটা ভোগান্তি পোহাতে হতো না।
রাজধানীর মালিবাগ এলাকার আরেক বাসিন্দা সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশন এখন অভিযান পরিচালনা করাতেই ব্যস্ত। মশা নিধনে বাজেটে এত টাকা রাখে, অথচ আমরা তাদের মশার ওষুধ ছিটাতেই দেখি না। ওষুধ না ছিটিয়ে শুধু অভিযানের দিকে বেশি নজর। রাজধানীতে এতো মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে, এর দায় অবশ্যই সিটি করপোরেশনের।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের দাবি, তাদের নিয়মিত অভিযান চলমান মশক নিধন কার্যক্রম, জনসচেতনতা, জনসম্পৃক্ততায় তাদের উদ্যোগ, সব মিলিয়ে ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমে আসতে শুরু করেছে। যা সফলতা বলে দাবি সংস্থা দুটির।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ২৩ আগস্ট দেশে নতুন করে ২৭৬ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাদের অধিকাংশই ছিলেন রাজধানীর বাসিন্দা। ওই সময় রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ২৪৩ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৩ জন।
গত ২৪ আগস্ট দেশে ২৫৮ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের অধিকাংশই রাজধানীর বাসিন্দা। ওই সময় রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ২১২ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৬ জন।
একইভাবে ২৫ আগস্ট নতুন করে ২৭৮ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের অধিকাংশই রাজধানীর বাসিন্দা। তখন রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ২৩০ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন ৪৮ জন।
২৬ আগস্ট নতুন করে ২৬৭ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাদের অধিকাংশই রাজধানীর বাসিন্দা। ওইদিন পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ২১৭ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫০ জন।
সর্বশেষ শুক্রবার (২৭ আগস্ট) নতুন করে ১৮৪ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের অধিকাংশই রাজধানীর বাসিন্দা। এর মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ১৬৯ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫ জন। বিগত কয়েকদিনের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে আগের চেয়ে ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে।
সম্প্রতি জনসচেতনতা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, মেয়র কিংবা কাউন্সিলর কারও একার পক্ষেই এডিস মশা ও ডেঙ্গু মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এডিস মশা ও ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে হবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও কাউন্সিলরদের সঙ্গে নিয়ে তার নেতৃত্বে ডিএনসিসির ১০টি অঞ্চলের ৫৪টি ওয়ার্ডেই জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এডিসের লার্ভা ধ্বংসে গত ২৭ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত মোট ৬৫ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেছিলেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় নগরবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের সুফল হিসেবেই রাজধানীর অন্যান্য এলাকার তুলনায় ডিএনসিসি এলাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক অনেক আসছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কম হলেও এটিকে শূন্যে কিংবা সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, আমরা এডিস মশার উৎসস্থলগুলো ধ্বংস করছি। কিন্তু পুরো শ্রাবণ মাস জুড়ে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। ফলে বিভিন্ন জায়গায় এখনো পানি জমছে। আমাদের যদি এক বাসায় তিনবার যেতে হয় তাহলে কাজটি অত্যন্ত কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু সচেতন হলে কাজটি আমাদের জন্য কার্যকর হয়। আমরা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে যে তালিকা পাচ্ছি, সেটা ধরে ডেঙ্গু রোগীদের বাসায় বাসায় যাচ্ছি। সঠিক তথ্য পেলে আরও কার্যকরভাবে এটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব।
তিনি আরও বলেন, চিরুনি অভিযানের মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগীর ঊর্ধ্বমুখী গতি নিম্নমুখী হয়েছে। ইনশাহ আল্লাহ অভিযানের মাধ্যমে এডিসের বিস্তার থেকে ঢাকাবাসীকে নিস্তার দিতে পারব।
এদিকে ডিএসসিসির ডেঙ্গুবিরোধী অভিযান প্রসঙ্গে জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বলেন, ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবারও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন অঞ্চলে ৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৪০৩টি নির্মাণাধীন স্থাপনা ও বাসাবাড়িতে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়ায় ১১টি মামলায় ৩৫ হাজার ২০০ জরিমানা করা হয়। এভাবে ডিএসসিসি এলাকায় নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।
জানা গেছে, চলতি বাজেটে মশক নিধনে বরাদ্দ কমিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় আট কোটি টাকা কমিয়ে ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে। যেখানে গত অর্থবছরে ৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে গত বছরের সংশোধিত বাজেটে রাখা হয় ২৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বাজেটে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরে ছিল ৪৯ কোটি টাকা আর সংশোধিত বাজেটে ছিল ৫৮ কোটি টাকা।
এএসএস/এমএইচএস