অঞ্চলভিত্তিক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রস্তাব দেবে ঢাকা
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয়ে আসা রোহিঙ্গারা/ ফাইল ছবি
>> কাল বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ-চীন-মিয়ানমার
>> চীনকে আরও জোরালো ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হবে
>> রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোই লক্ষ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
>> চীনকে দুই বছরের ব্যর্থতার বিষয়টি বুঝিয়ে দিতে হবে
>> প্রস্তাব মেনে নিলেও আস্থা রাখা যাবে না মিয়ানমারের ওপর
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। তিন দেশের সচিব পর্যায়ের বৈঠকটি মঙ্গলবার (১৯ জানুয়ারি) ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে।
বিজ্ঞাপন
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে মরিয়া বাংলাদেশ এবাবের বৈঠকে একটি গ্রাম বা অঞ্চলের রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রস্তাব দেবে। আর সেটা যত দ্রুত সম্ভব শুরু করার বিষয়েও তাগিদ দেবে ঢাকা।
সোমবার (১৮ জানুয়ারি) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের এলোমেলোভাবে চিহ্নিত না করে একটি গ্রাম বা অঞ্চলভিত্তিক রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ ভূমে ফেরত পাঠানোর মাধ্যমে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর প্রস্তাব দেবে ঢাকা। শুধু তাই নয়, আগামী বর্ষার আগে যে করেই হোক প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে জোর দেওয়া হবে।
আগামীকাল দুপুরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ত্রিপক্ষীয় এই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার লি ঝা উই এবং মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব আই ই চান নিজ নিজ দেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, বিক্ষিপ্ত তালিকা ধরে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর চেয়ে একটি গ্রাম বা অঞ্চলের যে পরিমাণ লোকসংখ্যা আছে তাদের পুরোপুরি ফেরত পাঠানো বাস্তবসম্মত হবে। এতে রোহিঙ্গারাও উৎসাহিত হয়ে ফিরে যাবেন। সেই লক্ষ্যে এগোতে চায় সরকার। তাই বৈঠকেও এই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তুলে ধরবে ঢাকা।
অতীত অভিজ্ঞতায় নেইপিদোর (মিয়ানমারের রাজধানী) ওপর আস্থা রাখতে না পারায় বিষয়টিও এবারের বৈঠকে তুলে ধরে বেইজিংকে আরও সম্পৃক্ত ভূমিকা পালন করার অনুরোধও করা হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
বৈঠকে নতুন করে কী বিষয়ে আলোচনা হতে পারে- জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘এ বিষয়ে এখনই আমি মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো। এ নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে সরকার একটি গ্রাম বা অঞ্চলের রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে যে প্রস্তাব দিতে যাচ্ছে এটি ইতিবাচক হবে। তবে মিয়ানমার যদি এ প্রস্তাব মেনে নিলেও তাদের ওপর আস্থা রাখা যাবে না। এই প্রস্তাব চূড়ান্ত ফলাফলে রূপ দিতে চীনকে সঙ্গে রাখতে হবে।
এর আগে, ২০১৯ সালে চীনের উদ্যোগে প্রথম ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসেছিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। সেই বৈঠকের পর নেইপিদোর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি তারা।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘যদি শুরু করতে হয় বিক্ষিপ্তভাবে ২০০ জনকে নিলাম তাদের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিলাম, সেটা না করে একটা গ্রাম বা এলাকার যারা আসছে তাদের সেখানে বসিয়ে দিলাম। এটা খুব ভালো প্রস্তাব। তবে মনে রাখতে হবে, মিয়ানমারকে পুরোপুরি বিশ্বাস কখনই করা যাবে না। সবসময় মনে রাখতে হবে, তারা অবস্থান থেকে সরে যেতে পারে। কিন্তু চীনারা যেহেতু এখানে জড়িত থাকছে, তাদের কাছে আমাদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে স্পষ্ট রোডম্যাপ তুলে ধরতে হবে।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চীনকে দুই বছর ধরে তাদের ব্যর্থতার বিষয়টি বুঝিয়ে দিতে হবে উল্লেখ করে সাবেক এ সচিব বলেন, ‘চীনকে বোঝাতে হবে, তোমরা বাংলাদেশের জন্য কিছুই করতে পারেনি। নিজেদের মুখ রক্ষায় হলেও প্রক্রিয়াটা শুরু কর। আমরা আশা করি, চীন এটা উপলব্ধি করবে। চীন দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দিক, তারা একটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করুক। দেখা যাক কী হয়?’
এর আগে, ২২ অক্টোবর চীনের পক্ষ থেকে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের বিষয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বার্তা আসে। সেদিন সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সঙ্গে টেলিফোন আলাপ করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই।
ফোনালাপের আলোচ্য বিষয় ছিল প্রত্যাবাসন ইস্যু। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে খুব দ্রুতই আলোচনায় বসতে চায়। এ নিয়ে দেশটির নির্বাচনের পর প্রথমে রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের মন্ত্রীপর্যায়ের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
ফোনালাপে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনকে জানান, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করছে চীন। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কীভাবে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ ভূমে ফেরত নেওয়া যায় সে জন্য মিয়ানমার কাজ করবে বলে চীনকে আশ্বস্ত করেছে।
সেই টেলিফোন আলাপের পর চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে মিয়ানমার সফর করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। মিয়ানমার সফরে থাকাকালীন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগামীকাল ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের তারিখ চূড়ান্ত করেন। বাংলাদেশ এতে সায় দেয়।
এদিকে, বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে নতুন করে আরও দুই লাখ ৩০ হাজার জনের তালিকা দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এর মধ্যে ২৮ হাজার জনকে নিজেদের নাগরিক বলে স্বীকার করেছে দেশটি। তালিকার ১৪ হাজার জনের তথ্য তাদের ডাটাবেজেই নেই বলে জানিয়েছে মিয়ানমার।
এ বিষয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ঢাকা পোস্ট-কে জানান, সম্প্রতি মিয়ানমারকে এই তালিকা হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ। দুই লাখ ৩০ হাজারের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা যাচাই-বাছাই করে সেখান থেকে ২৮ হাজার জনকে তাদের বাসিন্দা বলে স্বীকার করেছে মিয়ানমার। এদের মধ্যে ১৪ হাজার রোহিঙ্গার নাম দেশটির ডাটাবেজেই নেই বলে ঢাকাকে জানিয়েছে নেইপিদো।
যাচাই-বাছাই করাদের মধ্যে ৩৫০ জনকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।
আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি।
গত বছর দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হয়নি রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করেছে সরকার। সেখানে দুই দফায় তিন হাজার ৪৪৬ জন রোহিঙ্গাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গত ৪ ডিসেম্বর এক হাজার ৬৪২ আর ২৯ ডিসেম্বর এক হাজার ৮০৪ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানো হয়। সেখানে পর্যায়ক্রমে এক লাখ রোহিঙ্গাকে পাঠানো হবে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর ধারণা ছিল, বর্ষা, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের সময় ভাসানচর এলাকা ডুবে যেতে পারে। সে কারণে দ্বীপটি বসবাসের অনুপযোগী বলে তাদের ধারণা। একইসঙ্গে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জোর করে পাঠানো হচ্ছে বলেও দাবি করে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিশেষ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে এমনটাই দাবি করা হয়েছে।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়েছে, ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে দ্বীপটির কোনো ক্ষতি হয়নি। দ্বীপটি ৩০ বছরের পুরোনো। সেখানে আগে থেকেই মানুষজন ছিল। দ্বীপটি পুরোপুরি নিরাপদ। স্থানান্তরিত রোহিঙ্গারাও নিরাপদে থাকবেন। এছাড়া কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে সেখানে পাঠানো হচ্ছে না।
প্রায় তিন হাজার ১০০ কোটি টাকায় নির্মিত রোহিঙ্গাদের জন্য এই আবাসন প্রকল্পে এক লাখ এক হাজার ৩৬০ জন শরণার্থী বসবাস করতে পারবেন। সেখানে ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ঘরের সংখ্যা এক হাজার ৪৪০টি। প্রতিটি ঘরে প্রতি পরিবারের চারজন করে মোট ১৬টি পরিবার বসবাস করতে পারবে। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউজের এক প্রান্তে বসবাসকারী পরিবারের নারী-পুরুষদের জন্য আলাদা গোসলখানা ও শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং অন্য প্রান্তে রান্নাঘরও রয়েছে। রয়েছে বিদেশি প্রতিনিধিদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা।
এনআই/এফআর