রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টিতে আসতে অপহরণ করে হত্যা
এলাকার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের নজরে আসতে মোটরসাইকেল কেনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন হৃদয় হোসেন (২০) সাদ্দাম হোসেন (১৯) ও নাজমুল হোসেন (১৬) নামের তিন তরুণ। কিন্তু পারিবারিক আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে মোটরসাইকেল কেনার পরিকল্পনা করেন তারা।
সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী টার্গেট করে নানাজনের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে থাকে চক্রটি। অপহরণের পর ভিকটিমকে হত্যা করে তারা পোশাক ব্যবহার করে মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা করেন।
বিজ্ঞাপন
তবে টার্গেট করা ব্যক্তিরা বয়সে বড় হওয়ায় তারা শিশু আল আমিনকে (৭) অপহরণ করবে বলে সিদ্ধান্ত নেন। পরে আল আমিনকে কৌশলে তুলে নিয়ে যান তারা। পরে শিশুটিকে তারা হত্যা করেন। এরপর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে ধরা পড়েন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) জালে।
শনিবার (৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআইয়ের হেডকোয়াটার্সে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির মানিকগঞ্জ ইউনিটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম কে এইচ জাহাঙ্গীর আলম।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, গত ২৮ আগস্ট সকাল ৯ টার দিকে শিশু আল-আমিন বাড়ির সামনে কাঁচা রাস্তার উপর বাইসাইকেল চালানোর জন্য বের হয়। কিন্তু ১ ঘণ্টা পার হলেও আল আমিন বাড়িতে ফিরে না আসায় তার মা খোঁজাখুজি শুরু করেন। পরবর্তীতে বাড়ির আশপাশে ও সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুজি করে আল আমিনকে না পেয়ে পরের দিন আল-আমিনের বাবা শহিদুল ইসলাম সিংগাইর থানায় গিয়ে ছেলের নিখোঁজ সংক্রান্তে জিডি করেন।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ৩১ আগস্ট সকাল ১০ টার দিকে বেরুন্ডি গ্রামের চকে টেমা মিয়ার পরিত্যক্ত ভিটায় আল আমিনের মরদেহ খোঁজে পায় আশপাশের লোকজন। মরদেহ উদ্ধারের পর পর এ ঘটনায় ছায়া তদন্ত শুরু করে পিবিআই। পরে এ ঘটনায় স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ করে অপহরণ ও হত্যার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে পিবিআই-র দল। সেসব তথ্য পর্যালোচনা করে অভিযুক্ত তিন তরুণ হৃদয়, সাদ্দাম ও নাজমুলকে গ্রেফতার করে পিবিআই।
তিনি আরও বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছেন, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের জন্য কাউকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করার পরিকল্পনা করে তারা। তাদের মুক্তিপণ আদায়ের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রেফতার আসামি হৃদয় শিশু আল-আমিনকে বন্যার পানি দেখানোর কথা বলে সাপের ভিটায় (বড় বাঁশঝাড়) নিয়ে যায়। সেখানে নাজমুল আগেই অবস্থান করে। তারা দুজন প্রথমে আল-আমিনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার পরে নাজমুলের কাছে থাকা প্লাস্টিকের বস্তার মধ্যে মৃতদেহ ঢুকিয়ে ফেলে। আল-আমিনের পরনের গেঞ্জি ও প্যান্ট মুক্তিপণ আদায়ের প্রমাণ হিসেবে খুলে রাখে। এরপর লাশের বস্তাটি বাঁশঝাড়ের কাছাকাছি জায়গায় প্রায় হাঁটু পানিতে ডুবিয়ে রেখে একটি মুরগির নিটারের (বর্জ্য) বস্তা দিয়ে চাপা দেয়। এ সময় নাজমুলের ফোন থেকে হৃদয়, সাদ্দামকে ফোন দিয়ে বলে যে কাজ হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, ঘটনার পরে আল-আমিনের ব্যবহৃত সাইকেল দিনের বেলায় হৃদয় ও নাজমুল লুকিয়ে রাখে এবং এবং দিন রাতে হৃদয়দের বাড়ির পশ্চিম পাশে পুকুরের ফেলে দেয়। তারা ২৮ আগস্ট আল আমিনকে হত্যা করলেও ৩০ আগস্ট হৃদয় যে জায়গায় বস্তা পুঁতে রেখেছিল সেই বস্তা পানির নিচ থেকে তুলে পাশেই শুকনো জায়গায় মাটিতে গর্ত করে আবারও পুঁতে রাখে। যেকারণে স্থানীয়রা ওইদিন মৃতদেহটা খুঁজে পায়।
তিনি বলেন, তাদের পরিকল্পনা ছিল শিশুটিকে হত্যার পর নতুন সিম থেকে শিশুর স্বজনদেরকে ফোন দিয়ে মুক্তিপণ আদায় করবে। কিন্তু সাদ্দাম ঘটনার দিন নতুন সিম সংগ্রহ করতে না পারার কারণে অল-আমিনের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। তাই তারা মুক্তিপণও চাইতে পারেনি। কিন্তু মুক্তিপণ চাওয়ার আগেই স্থানীয়রা শিশুটির মৃতদেহ পেয়ে যাওয়ায় তারা এলাকা ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
তিনি বলেন, তারা পালানোর জন্য প্রথমে মানিকগঞ্জ থেকে সাভারের একটি হোটেলে ওঠে। সেখানে হোটেলবয়ের ফোন থেকে ওই শিশুর বাবার কাছে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চায় হৃদয়। কিন্তু তারা ভয়ে ছিল যেকোনো সময় ধরা পড়বে। তাই মুক্তিপণ চাইলেও তারা ওইদিন সাভার থেকে যশোরের বেনাপোল সীমান্তে চলে যায়। তারা চেয়েছিল সেখানে অবৈধভাবে ভারতে পালিয়ে যাবে। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর কড়া নজরদারি এবং অবৈধভাবে প্রবেশের জন্য যাদের সহযোগিতা প্রয়োজন তাদেরকে পর্যাপ্ত টাকা দিতে না পারায় তারা পালিয়ে ভারত যেতে ব্যর্থ হয়। পরে সেখান থেকে রাজবাড়ীতে পালিয়ে যায় তারা। সেখানে আত্মগোপনে থাকার চেষ্টা করলেও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে পিবিআইয়ের জালে ধরা পড়ে।
এমএসি/এইচকে