মা-বাবার সঙ্গে আরফা আনজুম - সংগৃহীত ছবি

‘আকাশের স্বপ্ন ছিল আরফা আনজুমকে (৪) ইঞ্জিনিয়ার বানাবে। সব সময় বলত- আব্বা, আমার একটাই স্বপ্ন, আমার মেয়েটাকে মানুষের মতো মানুষ করব। সে যেন বড় হয়ে তোমাদের সবার মুখ উজ্জ্বল করতে পারে।’

ছেলে হারানোর বেদনায় আর্তনাদ করে ঢাকা পোস্টের কাছে এ কথা বলেন রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়া আকাশ ইকবালের (৩৩) বাবা জাফর শেখ।

বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ে জাফর শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার ছেলে ও ছেলের বৌকে সড়কে খেয়ে নিলো। এখন আমার নাতনির কী হবে? আমার কলিজার টুকরা নাতনিকে দেখবে কে? আমি বাবা হয়ে ছেলের মরা মুখ কীভাবে দেখব? আমি কি ছেলের মরা মুখ, এতিম নাতিনের মুখ দেখার জন্য বেঁচে ছিলাম?’

বাবার সঙ্গে আরফা আনজুম

তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের আয়েই সংসার চলত, ছোট ছেলে কামরুলের পড়ালেখা চলত। বৌমা ফোন করে বলত, আব্বা আপনি কোনো কাজ করবেন না। আপনি হার্টের রোগী। সব সময় ওষুধ খাবেন আর হাসিখুশি থাকবেন। সংসার নিয়ে চিন্তা করবেন না। কামরুলের পড়ালেখা ও সংসার আমি আর আপনার ছেলে চালাব। রাক্ষুসে রাস্তায়  কী থেকে কী হয়ে গেল! আমার নাতিনকে এতিম করে ওরা কেন চলে গেল?’

মা-বাবার সঙ্গে আরফা আনজুম

সোমবার (১৮ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে সাতটার দিকে রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় যাত্রীবাহী বাসের চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী স্বামী-স্ত্রী স্বামী আকাশ ইকবাল (৩৩) মায়া হাজারিকা (২৫) নিহত হন। বিমানবন্দর এলাকার পদ্মা ওয়েল গেটের পাশে এ ঘটনা ঘটে। তাদের বাসা দক্ষিণখানের মোল্লারটেক এলাকায়। আকাশ-মিতুর দম্পতির চার বছরের মেয়ে আরফা আনজুম এখন এতিম।

ফরিদপুর সদর উপজেলার ধুলদি গ্রামের জাফর শেখের ছেলে আকাশ। একই এলাকাতে বাড়ি স্ত্রী মায়ারও। স্ত্রী মায়া ও চার বছরের একমাত্র মেয়ে আরফা আনজুমকে নিয়ে দক্ষিণখান মোল্লারটেক তেতুলতলা উদয়ন স্কুলের পাশে একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন তারা। আকাশ উত্তরায় একটি ডেভেলপার কোম্পানিতে চাকরি করতেন। মায়া বিমানবন্দরে একটি রেস্টুরেন্টে চাকরি করতেন।

মায়ের সঙ্গে আরফা আনজুম

ভাইকে নিয়ে যা বললেন কামরুল ইসলাম
আকাশের ভাই কামরুল ইসলাম বলেন, ‘‘গতকাল রাতেও ভাইয়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ভাই আমাকে বলেছে, ‘কামরুল তুই ভালো করে পড়ালেখা কর। আমি আছি চিন্তা করিস না। আর সকালে আমি তোকে ফোন দেবো, কিছু কথা আছে আমার।’’

কামরুল বলেন, ‘আমি ফরিদপুর পলিটেকনিকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ভাই আমাকে বলত, তোর ভাতিজিকে তোর মতো ইঞ্জিনিয়ার বানাব। তাকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিএসসি করাব। জীবনে আমার মেয়েকে নিয়ে এই স্বপ্ন। চারদিন আগে আমার ভাতিজিকে ভাই-ভাবী স্কুলে ভর্তি করিয়েছিল।’

বাবার সঙ্গে আরফা

এদিকে মেয়ে এবং মেয়ের জামাইকে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে শোকে কাতর ফিরোজা বেগম। তিনি বার বার বলছেন, ‘আমার মেয়ের ও জামাই কই গেল? বাসের ড্রাইবার কেমন গাড়ি চালাইলো যে আমার মেয়ে-জামাই জায়গায় মারা গেল? আমার জামাই-মেয়ের মধ্যে এত মিল ছিল...। আমার নাতনি তো এতিম হয়ে গেল। আমি ওর মুখের দিকে তাকাতে পারি না।’

যেভাবে ঘটে দুর্ঘটনা
সোমবার সকাল ৭টার দিকে বিমানবন্দর পদ্মা ওয়েল পাম্প গেটের সামনে আজমেরী পরিবহনের একটি বাস আকাশ ইকবালের মোটরসাইকেলকে চাপা দেয়। এতে আকাশ ও তার স্ত্রী মায়া ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরে বিমানবন্দর থানা পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। ঘটনার পরপরই ঘাতক বাসটিকে জব্দ করেছে পুলিশ। তবে বাসের চালক পালিয়ে গেছেন।

পুলিশ যা বলছে
এ বিষয়ে বিমানবন্দর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বিএম ফরমান আলী জানান, প্রথমে যাত্রীবাহী বাস মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দিলে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ছিটকে রাস্তায় পড়ে যান। পরে বাসটি তাদের চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই মারা যান তারা। এ ঘটনায় বাসটি জব্দ করা হলেও চালক পালিয়ে গেছেন। চালককে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। আর মামলার বিষয়ে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

বিমানবন্দর জোনের ট্রাফিক পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) এস আশিকুর রহমান জানান, পদ্মা ওয়েল ইউলুপের কাছে কুয়াশার কারণে বাসটি পেছন থেকে ধাক্কা দিলে মোটরসাইকেলে থাকা স্বামী-স্ত্রী নিহত হন।

এসআই মশিউল আলম বলেন, ‘নিহত দুজনেরই মাথায় হেলমেট ছিল। পুলিশের মামলা থেকে বাঁচতে তারা নামমাত্র হেলমেট পরেছিল। নিম্নমানের হেলমেটে তাদের জীবন রক্ষা হয়নি।’

এমএসি/এইচকে