ত্রিপক্ষীয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন | ছবি- ঢাকা পোস্ট

কক্সবাজা‌রে আশ্রিত রো‌হিঙ্গা‌দের প্রত‌্যাবাসন শুরুর বিষ‌য়ে একমত হ‌তে পা‌রে‌নি বাংলা‌দেশ ও মিয়ানমার। মঙ্গলবার (১৯ জানুয়ারি) ত্রিপক্ষীয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এমন তথ্য জানান পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।

বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টার পর বাংলাদেশ-চীন-মিয়ানমারের মধ্যে সচিবপর্যায়ের ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। 

বৈঠ‌কে রো‌হিঙ্গাদের গ্রাম বা অঞ্চল ধ‌রে প্রত‌্যাবাসন শুরু কর‌তে মিয়ানমার‌কে প্রস্তাব দেয় ঢাকা। এতেও আগ্রহ দেখায়‌নি দেশ‌টি। পররাষ্ট্র স‌চিব বলেন, বৈঠ‌কে আগামী ফেব্রুয়া‌রির প্রথম সপ্তা‌হে দুই দে‌শের ওয়া‌র্কিং গ্রুপের ভার্চুয়াল বৈঠক অনু‌ষ্ঠিত হ‌বে। একইস‌ঙ্গে দুই দে‌শের ম‌ধ্যে ‘রো‌হিঙ্গা সমস্যা’ নি‌য়ে কথা বল‌তে স‌চি‌বপর্যা‌য়ে এক‌টি হটলাইন চালুর কথা বলা হয়।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর ঢল নামে রোহিঙ্গাদের | ছবি- সংগৃহীত 
আমরা ফার্স্ট কোয়ার্টা‌রে তা‌দের ফেরত পাঠা‌নোর কথা ব‌লে‌ছি। ত‌বে তারা বলেছে, এই কম সম‌য়ে ল‌জি‌স্টিক সমর্থনের অভাবে তা‌দের ফেরত নেওয়া ক‌ঠিন। ত‌বে আমরা আশা কর‌ছি, সে‌কেন্ড কোয়ার্টা‌রে প্রত‌্যাবাসন শুরু কর‌তে পারব

পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন

পররাষ্ট্র স‌চিব ব‌লেন, ‘আমরা ফার্স্ট কোয়ার্টা‌রে তা‌দের ফেরত পাঠা‌নোর কথা ব‌লে‌ছি। ত‌বে তারা বলেছে, এই কম সম‌য়ে ল‌জি‌স্টিক সমর্থনের অভাবে তা‌দের ফেরত নেওয়া ক‌ঠিন। ত‌বে আমরা আশা কর‌ছি, সে‌কেন্ড কোয়ার্টা‌রে প্রত‌্যাবাসন শুরু কর‌তে পারব।’

প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলা ভার্চুয়াল বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। চীনের পক্ষে ছিলেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার লু ঝা উই এবং মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব আই উ চান।

পররাষ্ট্র স‌চিব বলেন, ‘ফেব্রুয়া‌রি‌তে ওয়া‌র্কিং গ্রু‌পের বৈঠক শে‌ষে তিন দে‌শের ভাইস মি‌নিস্টার পর্যায়ের একটা বৈঠক করার প্রস্তাব দি‌য়ে‌ছি। সেটা কক্সবাজার বা ঢাকায় হ‌তে পা‌রে। চীন এতে সম্মত হ‌য়ে‌ছে।’ এরপর মন্ত্রিপর্যা‌য়ে বৈঠক করা হ‌বে ব‌লেও জানান স‌চিব।

কক্সবাজারে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের একটি ক্যাম্প | ছবি- সংগৃহীত
ইতোম‌ধ্যে আমরা তা‌দের ক‌য়েকটা তা‌লিকা দি‌য়ে‌ছি। তারা ব‌লে‌ছে, তা‌লিকা নি‌শ্চি‌তের কার্যক্রম আরও ত্বরা‌ন্বিত করা হ‌বে

পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন

মাসুদ বিন মো‌মেন ব‌লেন, ‘বৈঠ‌কে আগের চে‌য়ে নমনীয় অবস্থা‌নে দেখা গে‌ছে মিয়ানমারকে। আমরাও তা‌দের স‌ঙ্গে ইতিবাচক কথা ব‌লে‌ছি।’

‘রোহিঙ্গা প্রত‌্যাবাসনে আন্তর্জা‌তিক মহলের উদ্যোগের বিষয়ে মিয়ানমার রা‌জি হয়েছে’ জা‌নি‌য়ে স‌চিব ব‌লেন, ‘আন্তর্জা‌তিক মহ‌লের সহ‌যো‌গিতা বা গঠনমূলক উদ্যোগকে তিন পক্ষ স্বাগত জানা‌বে। চায়না এখা‌নে আছে, এর বাইরে বি‌শেষ ক‌রে জা‌তিসংঘ, তারা য‌দি গঠনমূলক দা‌য়িত্ব নি‌তে চায় সেটাও গ্রহণ করা হ‌বে।’

রো‌হিঙ্গা‌দের তা‌লিকা ত্বরা‌ন্বিত কর‌তে বৈঠ‌কে আলোচনা হ‌য়ে‌ছে ব‌লে জানান স‌চিব। তি‌নি ব‌লেন, ‘ভে‌রি‌ফি‌কেশন ইস্যু কীভা‌বে আরও ত্বরা‌ন্বিত করা যায় সে বিষ‌য়ে আলোচনা হ‌য়ে‌ছে। ইতোম‌ধ্যে আমরা তা‌দের ক‌য়েকটা তা‌লিকা দি‌য়ে‌ছি। তারা ব‌লে‌ছে, তা‌লিকা নি‌শ্চি‌তের কার্যক্রম আরও ত্বরা‌ন্বিত করা হ‌বে।’

আমরা ব‌লে‌ছি, তোমরা তাদের (রো‌হিঙ্গা) ফেরার বিষয়ে যে শঙ্কা, সেটা কমা‌নোর চেষ্টা কর। তারা ব‌লে‌ছে, তারা (মিয়ানমার) এসে রো‌হিঙ্গা‌দের বোঝা‌বে। আমরাও কাজটা কর‌ব

পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন

প্রত‌্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করা হ‌বে কি-না, সাংবা‌দিক‌দের এমন প্রশ্নের জবা‌বে স‌চিব ব‌লেন, ‘আমরা চেষ্টা কর‌ছি। আমরা আশাবাদী।

দ্বিতীয় দফায় ভাসানচরে নেওয়া হয় ১৭৭২ রোহিঙ্গাকে | ছবি- সংগৃহীত

বৈঠ‌কে চী‌নের অবস্থান নি‌য়ে স‌চিব জানান, রো‌হিঙ্গা‌দের ফেরা‌নো নি‌য়ে গ্রাম বা অঞ্চলভিত্তিক প্রস্তা‌বে চীন সম্মত হ‌য়ে‌ছে। এছাড়া প্রথম ব‌্যা‌চে যেসব রো‌হিঙ্গা দে‌শে ফির‌বে তা‌দের ভ্যাকসিনেটেড (টিকা দেওয়া) ক‌রা হবে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দেশটিতে সহায়ক প‌রি‌বেশের বিষয়ে স‌চিব ব‌লেন, ‘সেখানে সহায়ক প‌রি‌বেশ তৈরি করা হবে বলে দেশটি জানিয়েছে। আমরা ব‌লে‌ছি, তোমরা তাদের (রো‌হিঙ্গা) ফেরার বিষয়ে যে শঙ্কা, সেটা কমা‌নোর চেষ্টা কর। তারা ব‌লে‌ছে, তারা (মিয়ানমার) এসে রো‌হিঙ্গা‌দের বোঝা‌বে। আমরাও কাজটা কর‌ব।’

আগামী জুনের ম‌ধ্যে পু‌রো রোহিঙ্গা ক‌্যাম্প বেড়ায় আবৃত করা হ‌বে ব‌লেও জানান পররাষ্ট্র সচিব।

এর আগে, ২২ অক্টোবর চীনের পক্ষ থেকে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের বিষয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বার্তা আসে। সেদিন সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। ফোনালাপের আলোচ্য বিষয় ছিল প্রত্যাবাসন ইস্যু। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে খুব দ্রুতই আলোচনায় বসতে চায়। এ নিয়ে দেশটির নির্বাচনের পর প্রথমে রাষ্ট্রদূতপর্যায়ে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের মন্ত্রিপর্যায়ের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে নতুন করে আরও দুই লাখ ৩০ হাজার জনের তালিকা দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এর মধ্যে ২৮ হাজার জনকে নিজেদের নাগরিক বলে স্বীকার করেছে দেশটি। তালিকার ১৪ হাজার জনের তথ্য তাদের ডাটাবেজে নেই বলে জানিয়েছে মিয়ানমার।

ফোনালাপে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনকে জানান, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করছে চীন। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কীভাবে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ ভূমিতে ফেরত নেওয়া যায় সেজন্য মিয়ানমার কাজ করবে বলে চীনকে আশ্বস্ত করেছে।

ওই টেলিফোন আলাপের পর চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে মিয়ানমার সফর করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। মিয়ানমার সফরের সময় চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের তারিখ চূড়ান্ত করেন। বাংলাদেশ এতে সায় দেয়। যা আজ অনুষ্ঠিত হলো।

নাগরিকত্ব ছাড়া প্রত্যাবাসন নয়, এমন দাবি সব রোহিঙ্গার | ছবি- সংগৃহীত

আরও দুই লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর 
 
বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে নতুন করে আরও দুই লাখ ৩০ হাজার জনের তালিকা দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এর মধ্যে ২৮ হাজার জনকে নিজেদের নাগরিক বলে স্বীকার করেছে দেশটি। তালিকার ১৪ হাজার জনের তথ্য তাদের ডাটাবেজে নেই বলে জানিয়েছে মিয়ানমার।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।

এ বিষয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ঢাকা পোস্ট-কে জানান, সম্প্রতি মিয়ানমারকে এই তালিকা হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ। দুই লাখ ৩০ হাজারের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা যাচাই-বাছাই করে সেখান থেকে ২৮ হাজার জনকে তাদের বাসিন্দা বলে স্বীকার করেছে মিয়ানমার। তাদের মধ্যে ১৪ হাজার রোহিঙ্গার নাম দেশটির ডাটাবেজে নেই বলে ঢাকাকে জানিয়েছে নেইপিদো।

যাচাই-বাছাই করাদের মধ্যে ৩৫০ জনকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসী হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।

আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি। গত বছর দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হননি রোহিঙ্গারা।

এনআই/এমএআর/