মিহির রায়

রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকা থেকে অপহরণকারী চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। আসামিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তুলে নিয়ে ভিক্টিমের পরিবারের কাছে টাকা দাবি করত। টাকা আদায়ের পর ভিকটিমদের নির্জন এলাকায় ফেলে দেওয়া হতো।

গ্রেপ্তার হওয়া এ চক্রের দুই সদস্য হচ্ছেন- মিরাজ ও বৃষ্টি। মঙ্গলবার (১৯ জানুয়ারি) ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এবিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার।

যে ঘটনায় গ্রেপ্তার মিরাজ-বৃষ্টি
ডিবি জানায়, গত ১৩ জানুয়ারি মিহির রায় নামের ফাস্টফুড দোকানের মালিককে তারা অপহরণ করে। এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মিহিরের দোকানে অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা এসে বলে, দোকানের খাবার খুব ভালো লেগেছে। ৮০ প্যাকেট খাবার অর্ডার দেবে বলে মিহিরকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যায়। পরে তাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে অপহরণ করা হয়।  

চক্রটি মিহিরকে অপহরণের পর তার স্ত্রীর কাছে ২০ লাখ টাকা দাবি করে। মিহিরের স্ত্রী ২ লাখ ৯১ হাজার টাকা বিকাশে পাঠান। পরে ডিবি তদন্ত করে তাদের অবস্থান শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করে। 

এসময় চক্রের কয়েকজন পালিয়ে যায়। এ দুজনের থেকে অপহরণের কাজে ব্যবহৃত ছুরি, স্ক্রু ড্রাইভার, প্লাইয়ার্সম ৫৭টি ইলেক্ট্রিক্যাল কেবল টাইস ও ৪৯ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।

‘আমাকে মেরে ফোনে স্ত্রীকে আমার চিৎকার শোনানো হতো’
অপহরণকারীদের থেকে উদ্ধার হওয়া মিহির বলেন, ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার দিকে বাসার সামনে যাওয়ার পর হঠাৎ আনুমানিক পাঁচ পুরুষ ও এক নারী আমার হাত-পা বেঁধে মুখে স্কচটেপ পেঁচিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে। রুমে নিয়ে তারা আমায় শারীরিক নির্যাতন করে। ওদের কথা শুনে বুঝতে পারি যে আমি অপহরণের শিকার।

মিহির জানায়, চক্রটি তার স্ত্রীকে ফোন করে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চায়। এত টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে মিহিরকে হত্যার হুমকি দেয়। পরে তার স্ত্রী ১০ লাখ টাকা দিতে রাজি হয়। বিকাশের মাধ্যমে তাদের ২ লাখ ৯১ হাজার টাকাও পাঠায় মিহিরের স্ত্রী। এসময় তিনি আইনের আশ্রয় নেন।

মিহির রায় বলেন, আমাকে শারীরিক নির্যাতন করা হতো। আমাকে মেরে স্ত্রীকে ফোন দিয়ে আমার চিৎকার শোনাতো। প্রতি রাতে দুটি ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে ঘুমিয়ে রাখা হতো।

নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন আরেক ভিক্টিম
মিহিরের অপহরণকারীদের গ্রেপ্তারের সংবাদ শুনে ডিবি অফিসে আসেন নেয়ামত উল্লাহ্‌ নামের আরেক ব্যবসায়ী। এসে শনাক্ত করেন যে এ চক্রটি তাকেও অপহরণ করেছিল। তিনি অপহরণকারীদের ১৪ দিনে ৫ লাখ টাকা দিয়ে মুক্ত হয়েছিলেন। নেয়ামত উল্লাহ্‌ একজন গাড়িচালক। তিনি রেন্ট-এ-কারের একটি গাড়ি ভাড়া নিয়ে চালান।

নেয়ামত উল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে বিমানবন্দর সড়কে গাড়ি চালানোর সময় একটি হাইস গাড়ি আমার পিছু নেয়। এক পর্যায়ে তারা বাম দিকে চাপ দেয়। আমি ডানে যাওয়ার চেষ্টা করলেও তারা আমাকে যেতে না দিয়ে সামনে থেকে আটকে ফেলে। ডিবি পুলিশের জ্যাকেটের মতই কিছু একটা পড়েছিল তারা। আটকানোর পরে গাড়ি থামাতে দেরির কারণ জানতে চায় তারা। একই সাথে গাড়ির কাগজ চায়। কাগজ দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা মেরে বলে যে ‘লাইসেন্স নিয়ে স্যারের কাছে যা।’ লাইসেন্স নিয়ে সামনে যেতেই গাড়িতে তুলে হাত-পা, চোখ-মুখ বেঁধে ফেলে। এরপর আর কিছু বুঝতে পারিনি।

তিনি বলেন, চক্রটি প্রথমে ২০ লাখ টাকা দাবি করে। পরের দিন তা ১৫ লাখে নামিয়ে আনে। একপর্যায়ে ১১ লাখ টাকা চায়। এত টাকা দেওয়ার সামর্থ নেই বলায় ব্যাপক নির্যাতন করে। বৈদ্যুতিক শক দেয়। চক্রটি আমার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে বুঝতে পারে যে সত্যি আমার এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। পরে তারা আমার কাছে পাঁচ লাখ টাকা চায়।

নেয়ামত উল্লাহ বলেন, অপহরণকারীরা আমার সঙ্গে পরিবারের কথা বলিয়ে দেয়। আমার স্ত্রীকে বলতে বলে যে, ওরা আমার কাছে টাকা পায়। পাওনা টাকা দিলেই আমাকে যেতে দেবে। আমি এভাবেই আমার স্ত্রীকে বলি। পরে ধাপে ধাপে ৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা দেওয়া হলে অপহরণের ১৪ দিন পর পূর্বাচলের ৩০০ ফিট সড়কে ফেলে দিয়ে যায়।

নেয়ামত উল্লাহ আরো জানান, তারা ঠিকমতো খাবার দিত না, নামাজ পড়তে দিত না। আমি কখনও ওযু ছাড়া নামাজ পড়তাম, কখনও ইশারায় নামাজ পড়তাম।

যা বললো আসামিরা
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, আসামিরা বেশ আগে থেকে এই কাজের সাথে জড়িত বলে স্বীকার করেছে। গত দুই মাসে ৩/৪ জনকে অপহরণ করেছে বলে জানা গেছে। টাকা আদায়ের পর যাতে পুলিশের কাছে মুখ খুলতে না পারে সেজন্য চক্রের নারী সদস্যের সঙ্গে ভিকটিমের আপত্তিকর ছবি তুলতে বাধ্য করত।

বৃষ্টির ভূমিকা ছিল আপত্তিকর ছবি তোলা
বৃষ্টি এই চক্রের অন্যতম সদস্য। ভিকটিমের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার পর ভিক্টিমের মুখ বন্ধ রাখতে কাজ করত বৃষ্টি। ডিবি জানায়, ভিকটিম মুক্ত হয়ে পুলিশের কাছে যাতে মুখ খুলতে না পারে তাই বৃষ্টির সঙ্গে তাদের আপত্তিকর ছবি তুলে রাখা হতো। পুলিশকে বললে এসব ছবি ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হতো।

ডিবির প্রধান হাফিজ আক্তার বলেন, চক্রটি অপহরণের ঘটনায় ১০ হাজার টাকা দিয়ে একজন যৌনকর্মী ঠিক করতো। ঐ নারীকে দিয়ে রান্নার কাজের পাশাপাশি নিয়মিত অসামাজিক কাজে লিপ্ত হতো। তারা অপহরণকারীর পরিবারের থেকে মুক্তিপণ পেয়ে ভিকটিমকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তাকে উলঙ্গ করে ওই নারীর সঙ্গে অসংলগ্ন ছবি তুলে রাখত। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে কেউই পুলিশের কাছে মুখ খুলত না।

এআর/এমএসি/ওএফ