বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফাইল ছবি

২০১৭ সালে হওয়া চুক্তির ভিত্তিতেই বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফেরাতে চায় বলে জানিয়েছেন দেশটির আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী কাইয়া টিন।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনকে লেখা এক চিঠিতে তিনি এ প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন।

শুক্রবার (২২ জানুয়ারি) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এতে বলা হয়, সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনকে লেখা এক চিঠিতে মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী কাইয়া টিন জানান, ২০১৭ সালে দুই দেশের মধ্যে হওয়া চুক্তির ভিত্তিতে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।

২০১৭ সালের হওয়া সেই সমঝোতা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের যারা স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চাইবে, তাদেরকেই মিয়ানমারে পাঠানো যাবে। বাংলাদেশ কাউকে জোর করে ফেরত পাঠাতে পারবে না। তবে সেসময় একজন রোহিঙ্গাও দেশটিতে ফেরত যেতে রাজি হয়নি। মিয়ানমারও চুক্তির বাস্তবায়নে কোনো ভূমিকা রাখেনি।

গত ১৯ জানুয়ারি চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দ্রুত দেশে ফেরানোর বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন কাইয়া টিন।

এছাড়া বাংলাদেশসহ সকল প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান ও পারস্পারিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ক সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলেও জানান তিনি।

মিয়ানমার প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে পারস্পারিক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে যেকোনো দ্বিপাক্ষিক বিষয়ের সমাধান করতে চায়।

আব্দুল মোমেনকে লেখা চিঠিতে কাইয়া টিন

চিঠিতে তিনি জানান, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো তিনিও মনে করেন, করোনা মহামারির কারণে নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পারিক সংহতি ও সহযোগিতা প্রয়োজন।

পারস্পারিক অলোচনার ভিত্তিতে ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত নেওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেন দেশটির আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী।

এছাড়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সুস্বাস্থ্য এবং বাংলাদেশের জনগণের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন তিনি। গত ১ জানুয়ারি চিঠি পাঠানোর জন্য মোমেনকে ধন্যবাদও জানান মিয়ানমারের এ মন্ত্রী।

টিন-মোমেন একই সময়ে জাতিসংঘে নিজ নিজ দেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং সে সময় থেকে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে বলে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এর আগে, মঙ্গলবার (১৯ জানুয়ারি) চীনের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার।

তিন দেশের সচিব পর্যায়ের এ অনলাইন বৈঠকে ঢাকার পক্ষে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার লু ঝা উই ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব আই উ চান নিজ নিজ দেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন।

বৈঠকে প্রত্যাবাসন শুরু করতে ঢাকার দেওয়া প্রস্তাবে একমত হতে পারেনি মিয়ানমার। তবে চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে বলে আশা প্রকাশ করেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।

পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘আমরা প্রথম প্রান্তিকে প্রত্যাবাসন শুরু করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যবস্থাপনার জন্য আরও কিছুটা সময় লাগবে বলে জানিয়েছে মিয়ানমার। তাই আমরা দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রত্যাবাসনের কথা বলেছি। তারা এতে সম্মত হয়েছে।’

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সময় রাখাইনে আন্তর্জাতিক সংস্থার উপস্থিতির বিষয়ে দেওয়া প্রস্তাবে চীন ও মিয়ানমার ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে বলেও জানান সচিব মাসুদ বিন মোমেন।

ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে রোহিঙ্গাদের গ্রামভিত্তিক প্রত্যাবাসনের প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। তবে এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি মিয়ানমার। ছয় দফায় মোট আট লাখ জন রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ সরকার, এর মধ্যে ৪২ হাজারের ভেরিফিকেশন করেছে মিয়ানমার।

এর আগে, ২০১৯ সালে চীনের উদ্যোগে প্রথম ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসেছিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। সে বৈঠকের পর নেইপিদোর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও একজনকেও ফেরত নেয়নি তারা। পরে গত বছরের ২২ অক্টোবর চীনের পক্ষ থেকে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের বিষয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বার্তা আসে। সেদিন সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সঙ্গে টেলিফোন আলাপ করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মাঝে একটি চুক্তি হয়েছিল। ওই চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি থেকে প্রত্যাবাসন শুরুর কথা ছিল। তবে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি।

২০১৯ সালে দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হননি রোহিঙ্গারা।

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মিত আবাসন প্রকল্প

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করেছে সরকার। সেখানে দুই দফায় তিন হাজার ৪৪৬ জন রোহিঙ্গাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গত ৪ ডিসেম্বর এক হাজার ৬৪২ আর ২৯ ডিসেম্বর এক হাজার ৮০৪ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানো হয়। সেখানে পর্যায়ক্রমে এক লাখ রোহিঙ্গাকে পাঠানো হবে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর ধারণা ছিল, বর্ষা, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের সময় ভাসানচর এলাকা ডুবে যেতে পারে। সে কারণে দ্বীপটি বসবাসের অনুপযোগী বলে তাদের ধারণা। একইসঙ্গে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জোর করে পাঠানো হচ্ছে বলেও দাবি করে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিশেষ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে এমনটাই দাবি করা হয়েছে।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়েছে, ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে দ্বীপটির কোনো ক্ষতি হয়নি। দ্বীপটি ৩০ বছরের পুরোনো। সেখানে আগে থেকেই মানুষজন ছিল। দ্বীপটি পুরোপুরি নিরাপদ। স্থানান্তরিত রোহিঙ্গারাও নিরাপদে থাকবেন। এছাড়া কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে সেখানে পাঠানো হচ্ছে না।  

প্রায় তিন হাজার ১০০ কোটি টাকায় নির্মিত রোহিঙ্গাদের জন্য এই আবাসন প্রকল্পে এক লাখ এক হাজার ৩৬০ জন শরণার্থী বসবাস করতে পারবেন। সেখানে ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ঘরের সংখ্যা এক হাজার ৪৪০টি। প্রতিটি ঘরে প্রতি পরিবারের চারজন করে মোট ১৬টি পরিবার বসবাস করতে পারবে। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউজের এক প্রান্তে বসবাসকারী পরিবারের নারী-পুরুষদের জন্য আলাদা গোসলখানা ও শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং অন্য প্রান্তে রান্নাঘরও রয়েছে। রয়েছে বিদেশি প্রতিনিধিদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা।

এনআই/এফআর