পলাতক, অপহরণ নাকি হত্যা!
রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে মা ও মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় বাড়ছে রহস্য। আটদিন পার হলেও প্রকৃত ঘটনা কী, জানতে পারেনি পুলিশ। নিখোঁজ মা ও মেয়ে কি অপহরণের শিকার হয়েছেন, নাকি স্বেচ্ছায় পালিয়েছেন; সংশ্লিষ্টরা কেউ বলতে পারছেন না। অপহরণের পর তাদের হত্যা করা হতে পারে— এমন শঙ্কাও প্রকাশ করছেন পরিবারের কেউ কেউ।
মা ফাতেমা আক্তার আঁখি (২২) ও মেয়ে আতিফা রহমান আয়াত (৬) গত সোমবার (১৮ জানুয়ারি) বিকেলে বাসা থেকে বের হন। মেয়েকে টিউশনিতে নিয়ে যাচ্ছেন বলে বের হলেও পরে তারা আর বাসায় ফেরেননি। আঁখির স্বামী জিল্লুর রহমান (৩৩) সৌদিপ্রবাসী। শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে উত্তরখানের নামাপাড়া এলাকায় থাকতেন আঁখি ও তার মেয়ে।
বিজ্ঞাপন
নিখোঁজের পরের দিন মঙ্গলবার (১৯ জানুয়ারি) আঁখির মামা আবদুল কাইয়ুম ও দেবর মতিউর রহমান খিলক্ষেত থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। গত শুক্রবার (২২ জানুয়ারি) আঁখির দেবর মতিউর রহমান ওই ঘটনায় অপহরণ মামলা দায়ের করেন।
মা ফাতেমা আক্তার আঁখি (২২) ও মেয়ে আতিফা রহমান আয়াত (৬) গত সোমবার (১৮ জানুয়ারি) বিকেলে বাসা থেকে বের হন। মেয়েকে টিউশনিতে নিয়ে যাচ্ছেন বলে বের হলেও পরে তারা আর বাসায় ফেরেননি। আঁখির স্বামী জিল্লুর রহমান (৩৩) সৌদিপ্রবাসী। শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে উত্তরখানের নামাপাড়া এলাকায় থাকতেন আঁখি ও তার মেয়ে...
বিজ্ঞাপন
মা-মেয়ে নিখোঁজের ঘটনার শুরুতে আঁখির পরিবার ও তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন একই অভিযোগ করলেও এখন তারা ভিন্ন সুরে কথা বলছেন। এক পরিবার অন্য পরিবারের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। এ বিষয়ে পুলিশ বলছে, দুই পরিবারের অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে তারা তদন্ত করে দেখছেন।
আঁখির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার উজিরপুর ইউনিয়নের কৈইয়া গ্রামের বাসিন্দা ওমর ফারুক নামের যে যুবককে তারা প্রথমে সন্দেহ করেছিলেন, এখন তাকে আর সন্দেহ করছেন না। কারণ তারা জানতে পেরেছেন, ওমর ফারুক এখন সৌদি আরবে আছেন। তবে তার সৌদি আরবে থাকার বিষয়টিও শতভাগ নিশ্চিত নন তারা। ওমর ফারুকের দেশে না থাকার খবরে তার প্রতি সন্দেহের পরিমাণ হালকা হয়েছে আঁখির পরিবারের মধ্যে।
তাদের দাবি, মা ও মেয়ে নিখোঁজের আটদিন পর তারা নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছেন। ঢাকা পোস্টের কাছে অভিযোগ করে তারা বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে আঁখির শ্বশুর বাড়ির লোকজন জড়িত থাকতে পারে। এমন কিছু তথ্যও পেয়েছেন তারা। এখন আঁখি ও তার মেয়ে বেঁচে আছেন কি-না, তা নিয়ে শঙ্কিত তারা।
আঁখির স্বামীর বড় ভাই মশিউর রহমান তাকে অনেক সময় কু-প্রস্তাব দিতেন। আঁখি রাজি না হওয়ায় মশিউর রহমান তাকে নানাভাবে ডিস্টার্ব করতেন। মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আঁখিকে মারধরও করতেন মশিউর রহমান, বিষয়টি পরে আমরা জানতে পেরেছি
আঁখির মামা আবদুল কাইয়ুম
এ বিষয়ে আঁখির মামা আবদুল কাইয়ুম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা প্রথমে ওমর ফারুককে সন্দেহ করেছিলাম। কিন্তু সে এখন বিদেশে। তবে আমরা আঁখি ও তার মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর নতুন নতুন তথ্য জানতে পারছি। আঁখির স্বামীর বড় ভাই মশিউর রহমান তাকে অনেক সময় কু-প্রস্তাব দিতেন। আঁখি রাজি না হওয়ায় মশিউর রহমান তাকে নানাভাবে ডিস্টার্ব করতেন। মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আঁখিকে মারধরও করতেন মশিউর রহমান, বিষয়টি পরে আমরা জানতে পেরেছি।’
আঁখি ও তার মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার সাতদিন আগের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আঁখি নিখোঁজ হওয়ার সাতদিন আগে সে তার স্বামীকে ফোন করে বলেছিল, তুমি দ্রুত দেশে চলে আস, আমি বিপদে আছি। আঁখি সম্ভবত তার ভাসুরের বিষয়ে স্বামীকে কিছু বলতে চেয়েছিল। আমাদের এখন মনে হচ্ছে, আঁখির ভাসুর মশিউর রহমান এ ঘটনার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত। সে আঁখি ও আয়াতকে অপহরণ করে মেরে ফেলেছে কি-না, সেটা নিয়েও আমরা শঙ্কিত।
তিনি আরও বলেন, ‘ছেলের বৌ ও নাতিন নিখোঁজ হয়েছে, এ বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই আঁখির শ্বশুর বাড়ির লোকজনের। তারা কোনো না কোনোভাবে আঁখিকে দোষ দিতে চান প্রকৃত ঘটনা না জেনে। ঘটনার দিন ছয় ঘণ্টা ধরে তাদের বাড়ির বৌ ও নাতিন নিখোঁজ, তারা সেটা জানেই না। আঁখি ও তার মেয়ে বিকেল ৪টায় নিখোঁজ হয়, তারা আমাদের জানায় রাত ১০টায়। কারণ তারা অনেক ঘটনা আমাদের লুকাচ্ছে।’
ভাবির (আঁখি) পরিবারের পক্ষ থেকে এখন মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে। তার দোষ ঢাকার জন্য আমাদের পরিবারের ওপর মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে। আঁখির পরিবার ভালো করেই জানে কেন তাদের মেয়ে পালিয়েছে?
আঁখির দেবর মতিউর রহমান
এদিকে আঁখির শ্বশুর বাড়ির লোকজন বলছেন ভিন্ন কথা। থানায় অপহরণের মামলা করলেও তাদের ধারণা, আঁখি আয়াতকে নিয়ে কোনো ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে। নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার হয়নি তারা।
এ বিষয়ে আঁখির দেবর মতিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা প্রথমে একটা জিডি করেছিলাম। তবে শুক্রবার রাতে (২২ জানুয়ারি) অজ্ঞাত আসামি দিয়ে একটি অপহরণ মামলা করেছি। আমরা এখন পর্যন্ত যা শুনেছি তাতে মনে হচ্ছে, ভাবি কারও সঙ্গে পালিয়ে গেছে। কারণ ভাই বিদেশে যাওয়ার পর ভাবি কারও সঙ্গে তেমন মিশত না। একা একা একটি রুমে বসে সারাদিন মোবাইল ফোনে কথা বলত। কেন এবং কার সঙ্গে কথা বলত, বিষয়টি এখন সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। তবে ব্ল্যাকমেইলিং করে জিম্মি হিসেবেও তাদের রাখা হতে পারে।’
ভাসুর মশিউর রহমানের সঙ্গে আঁখির বিবাদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ভাবির (আঁখি) পরিবারের পক্ষ থেকে এখন মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে। তার দোষ ঢাকার জন্য আমাদের পরিবারের ওপর মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে। আঁখির পরিবার ভালো করেই জানে কেন তাদের মেয়ে পালিয়েছে?
এদিকে স্ত্রী ও মেয়ে নিখোঁজ হওয়ায় গত শনিবার (২৩ জানুয়ারি) বিকেলে সৌদি আরব থেকে দেশে আসেন জিল্লুর রহমান। তিনিও সন্দেহ করেন, তার স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে যাননি। তাদের কেউ ট্র্যাপে (ফাঁদে) ফেলে জিম্মি করে রেখেছে।
দুই পরিবার বেশকিছু অভিযোগ করেছে। বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তদন্ত চলছে। তবে নিখোঁজরা কি অপহরণের শিকার বা তাদের হত্যা করা হয়েছে কি-না, এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই
খিলক্ষেত থানার উপ-পরিদর্শক মিজানুর রহমান
এ বিষয়ে জিল্লুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার স্ত্রী নিখোঁজ হওয়ার সাতদিন আগে আমাকে ফোন দিয়ে বলেছিল, দেশে দ্রুত চলে আসতে। সে নাকি বড় কোনো বিপদে আছে। তবে এ বিষয়ে সে বিস্তারিত কিছু বলেনি। আমার ধারণা, আঁখি কোনো ছেলের সঙ্গে নিয়মিত ফোনে কথা বলত। সে ছেলের কাছে আঁখির হয়তো কোনো স্পর্শকাতর ছবি বা ভিডিও থাকতে পারে। এসব ছবি বা ভিডিও ঘটনার দিন আঁখি ওই ছেলের কাছ থেকে আনতে গেল তাকে জিম্মি করে রাখা হয়।’
পুলিশ যা বলছে
খিলক্ষেত থানা পুলিশ বলছে, ঘটনার শুরুর দিকে এত রহস্য না থাকলেও এখন একের পর এক অভিযোগ আসছে, বাড়ছে রহস্যও। শুরুর দিকে দুই পরিবার একই পথে হাঁটলেও এখন পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছে। এখন কে সত্য বলছে, কে মিথ্যা বলছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকর্মকর্তা ও খিলক্ষেত থানার উপ-পরিদর্শক মিজানুর ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুই পরিবার বেশকিছু অভিযোগ করেছে। বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তদন্ত চলছে। তবে নিখোঁজরা কি অপহরণের শিকার বা তাদের হত্যা করা হয়েছে কি-না, এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। তদন্ত শেষ করা ছাড়া অর্থাৎ নিখোঁজদের উদ্ধার না করা পর্যন্ত ঘটনার প্রকৃত রহস্য জানা যাচ্ছে না। এছাড়া আঁখির ফোন বারবার ট্রেস করার চেষ্টা করছি আমরা, কিন্তু তার ফোন বন্ধ থাকায় সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা তার গত তিন মাসের কললিস্ট পরীক্ষা করে দেখছি।
১৮ জানুয়ারি যা ঘটেছিল
ঘটনার দিন বিকেল সাড়ে ৪টায় আঁখি তার মেয়েকে নিয়ে শিক্ষকের কাছে যাচ্ছেন বলে বাসা থেকে বের হন। এ সময় মেয়ে আয়াতের কাঁধে স্কুলব্যাগ ছিল। আঁখির সঙ্গে ছিল ভেনেটি ব্যাগ। বাসা থেকে বের হওয়ার ঘণ্টাখানেক পরই তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ছয় ঘণ্টা পর শ্বশুর বাড়ির লোকজন আঁখির পরিবারকে ফোন করে বিষয়টি জানায়।
দুই পরিবারের বক্তব্যে যেখানে মিল
আঁখি ও তার মেয়ে নিখোঁজের পর দুই পরিবার প্রথমে একই সুরে কথা বলে। এখন তারা একে-অপরের ওপর অভিযোগ আনছেন। কিন্তু একটা বিষয়ে তাদের বক্তব্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তারা উভয়েই বলছে, ছয় মাস আগে ওমর ফারুক নামে এক যুবক আঁখির ফেসবুক আইডি হ্যাক করেন। তিনি আঁখির আইডি থেকে তার স্বামীর কাছে পাঠানো অনেক স্পর্শকাতর ছবি নিয়ে নেন। পরে এসব ছবি দেখিয়ে আঁখিকে বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকেন ওমর ফারুক।
পরে এ বিষয়ে আঁখি খিলক্ষেত থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর ওমর ফারুক আর ব্ল্যাকমেইল করত না বলে সে তার পরিবারকে জানায়। কিন্তু জিডির মাসখানেক পর আবারও ডিস্টার্ব করতে শুরু করে ওমর ফারুক। তার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ারও হুমকি দেয়।
পরে আঁখি ভয় পেয়ে ওমর ফারুকের বিভিন্ন অনৈতিক আবদার মেটাতে থাকেন। আঁখি প্রতি মাসে ওমর ফারুককে টাকা পাঠাতেন, সর্বশেষ তিনি তাকে ২০ হাজার টাকা বিকাশে পাঠিয়েছেন বলে অভিযোগ পরিবারের।
নিখোঁজের পর আঁখির পরিবার ও শ্বশুর বাড়ির সদস্যদের অভিযোগ, ওমর ফারুক আঁখিকে সব স্পর্শকাতর ছবি দিয়ে দেবে বলে ডেকে নেয়। এরপর থেকে মেয়েসহ আঁখি নিখোঁজ।
এমএসি/এমএআর/