মেম্বার রউফ হত্যা : সন্দেহভাজন ‘নেপথ্যে’র হোতাদের খোঁজা হচ্ছে
আগের দিন জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে পর দিনই খুন হন গাইবান্ধার সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আব্দুর রউফ মিয়া। ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে রউফকে হত্যার কথা এরই মধ্যে স্বীকার করেছেন গ্রেফতার হওয়া আসামি আরিফ মিয়া। যদিও নিহতের আত্মীয় স্বজনদের দাবি, রাজনৈতিক কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
র্যাব বলছে, আরিফ ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে খুন করেছে নবনির্বাচিত মেম্বার আব্দুর রউফকে। তবে এ ঘটনার নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ বা কারো সহায়তা, প্রলোভন কিংবা পরিকল্পনা ছিল কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
এদিকে রউফ হত্যার ঘটনায় বিচারের দাবিতে আজও লক্ষ্মীপুরে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখান থেকে অংশগ্রহণকারী এলাকাবাসী ও আত্মীয়রা, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার ও আরিফের ফাঁসি কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত ১২ নভেম্বর (শুক্রবার) রাত ১১টার দিকে গাইবান্ধা সদরের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য আব্দুর রউফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আব্দুর রউফ লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর মাগুরাকুটি গ্রামের মৃত ফজলুল হকের ছেলে। তিনি লক্ষ্মীপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক ছিলেন।
বিজ্ঞাপন
এ ঘটনায় গাইবান্ধা সদর থানায় নিহতের বড় বোন মমতাজ বেগম বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় আরিফ মিয়াসহ অজ্ঞাতনামা ৬-৭ জনকে আসামি করা হয়।
ঘটনার পরই ছায়া তদন্ত শুরু করে র্যাব-১৩। ১৩ নভেম্বর রাতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পঞ্চগড় জেলার বোদা থানার পাঁচপীর এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রধান আসামি আরিফ মিয়াকে (৩৩) গ্রেফতার করে র্যাব-১৩ এর একটি দল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গ্রেফতার আরিফ মিয়া খাদ্য বিভাগের নৈশপ্রহরী। উচ্ছৃঙ্খল আচরণের কারণে সম্প্রতি তাকে গাইবান্ধা থেকে দিনাজপুরে বদলি করা হয়। কিন্তু সেখানে তাকে যোগদান করতে দেননি অন্য কর্মচারীরা। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে।
গ্রেফতারের পর আরিফ হত্যাকাণ্ডে নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছে জানিয়ে র্যাব-১৩ অধিনায়ক কমান্ডার রেজা আহমেদ ফেরদৌস জানান, ইউপি সদস্যের সঙ্গে পারিবারিক বিরোধের জেরে এ ঘটনা ঘটেছে। আসামি আরিফ মিয়ার দুজন স্ত্রী ছিলেন। যারা তাকে ছেড়ে চলে যান। এর পেছনে ইউপি সদস্য আব্দুর রউফের হস্তক্ষেপ ছিল। আসামি আরিফ মিয়ার দাবি, এ বিরোধের কারণে হত্যার ঘটনাটি ঘটিয়েছেন। তবে এর পেছনে আর অন্য কোনো মোটিভ রয়েছে কি না, তা তদন্ত সাপেক্ষে বলা যেতে পারে।
ঘটনার আগের দিন আরিফ মিয়া স্থানীয় একটি ক্লাবে আব্দুর রউফ, নবনির্বাচিত চেয়ারম্যানসহ ২-৩ জনের ক্ষতি করবেন বলে আভাস দিয়েছিলেন। আরিফ মিয়া সরকারি চাকরি করেন এবং তিনি একসময় সরকারি দলের একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অন্যদিকে হত্যাকাণ্ডের শিকার ইউপি সদস্য আব্দুর রউফ বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। এ কারণে এই হত্যার ঘটনায় কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা ইন্ধন র্যাব পেয়েছে কি না, জানতে চাইলে রেজা আহমেদ বলেন, অপরাধীর পরিচয় অপরাধী। আমাদের কাছে তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য নয়। তবে সবকিছুই তদন্ত ও সময় সাপেক্ষে বলা যাবে।
মেম্বার রউফ হত্যার ব্যাপারে প্রতিবেশী ইব্রাহিম বেপারি ঢাকা পোস্টকে বলেন, রউফ মেম্বার খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। বিএনপিমনা এ মানুষটা ইউপি মেম্বার পদে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। রাজনৈতিক প্রভাব ও মেম্বার পদ থেকে তাকে সরাতেই কেউ এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ঘাতক আরিফ যা বলেছে, তার আড়ালেও ষড়যন্ত্র ছিল সেটা এখন এলাকায় ওপেন সিক্রেট। যেটার সত্যতা ও নেপথ্যের জড়িতদের খুঁজে বের করার দাবি আমাদের।
নিহতের ছোট ভাই মাইদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আরিফ নামে যে ছেলে রউফ ভাইকে খুন করেছে তার সঙ্গে জানা মতে পূর্বে চলাফেরা, বিরোধ কিংবা শত্রুতার কথা কখনো শুনিনি। আরিফ এই খুনে জড়িত থাকলেও অবশ্যই তাকে কেউ ব্যবহার করেছে। কারা ব্যবহার করেছে সেটা সঠিক তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে।
মামলার বাদী ও বড় বোন মমতাজ বেগম বলেন, আমার ভাইটার প্রকাশ্য কোনো শত্রু ছিল না। আমার ভাই খুন হয়েছে নির্বাচনের জেতার পর দিন রাতে। এটা মামুলি কোনো ঘটনা নয়। রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা শত্রুতা যে কারণেই হোক নেপথ্যে অন্য কারো যোগসাজশ রয়েছে। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হোক।
বুধবার দুপুরে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা জড়িত আসামি আরিফকে গ্রেফতার করেছি। সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। জবানবন্দিতে সে নিজের ব্যক্তিগত শত্রুতা ও বিরোধের কথা জানিয়েছে। তবে স্থানীয় ও আত্মীয়-স্বজনের অভিযোগ মেম্বার রউফ হত্যায় নেপথ্যে আরও কেউ রয়েছে। সেটি র্যাবের আমলে রয়েছে। গাইবান্ধা সদর থানা পুলিশ রউফ হত্যা মামলা তদন্ত করছে। এই হত্যায় র্যাবের ছায়া তদন্ত চলমান। এই হত্যায় নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ ও অন্য কারো হাত থাকলেও তা তদন্ত করা হবে এবং নেপথ্যে কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে গাইবান্ধা সদর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেম্বার আব্দুর রউফ হত্যায় তদন্ত চলছে। ইতোমধ্যে র্যাবের হাতে গ্রেফতার আরিফ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি গ্রহণ করা হবে। এই ঘটনায় আরিফ ছাড়া আরও কারো সংশ্লিষ্টতা ইন্ধন কিংবা যোগসাজশ ছিল কি না তাও খতিয়ে দেখা হবে।
জেইউ