সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ নিষিদ্ধ ও অননুমোদিত নছিমন, করিমন, আলমসাধু ও ভটভটির মতো দেশে তৈরি যানবাহন। এই তালিকায় আছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক বা রিকশাও, এগুলোরও নেই অনুমোদন। এসব যানবাহনের কারিগরি মানোন্নয়নের শর্তে নির্দিষ্ট সংখ্যায় ও এলাকাভেদে চলাচলের সুযোগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

এজন্য তৈরি করা হয়েছে থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় যানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন এবং মহাসড়ক বিভাগ এই খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে। তবে সড়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব যানবাহন নিবন্ধন ও চলাচলের অনুমোদন দেওয়া হলে সড়কে প্রাণহানি বাড়বে।

থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় যানের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা-২০২১-এর খসড়ায় নিষিদ্ধ যানবাহনের বৈধতা দেওয়ার বিষয়টি যুক্ত রয়েছে। আগামী ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই খসড়া নীতিমালার ওপর অংশীজনদের মতামত নেওয়া হবে। এজন্য সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ওয়েবসাইটে খসড়া নীতিমালা আপলোড করা হয়েছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিষিদ্ধ যানবাহনকে বৈধতা দিতে হলে আগে সেগুলো নিরাপদ ও উপযুক্ত করে তুলতে হবে। তাতে সড়কে প্রাণহানি বাড়ার আশঙ্কা থাকবে না। 

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেশি ঘটছে অননুমোদিত যানবাহনে। এজন্য এসব বাহনের ডিজাইনের উন্নয়ন করতে হবে। এসব যানবাহন গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। 

এই নীতিমালার তৈরির জন্য গঠিত সুপারিশ প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ইউছুব আলী মোল্লা বলেছেন, এ নীতিমালার বিষয়ে মতামত এসেছে। মতামত নেওয়া শেষ হবে আগামী ৭ ডিসেম্বর। তারপর আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হবে। এরপর বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে এ নীতিমালা চূড়ান্ত হবে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এখনো পর্যন্ত নছিমন, করিমন, আলমসাধু, ভটভটি, ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার নিবন্ধন দিচ্ছে না। এগুলোর চলাচলের ব্যাপারেও বিআরটিএ কোনো অনুমোদন দেয়নি। এসব বাহন বন্ধে ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এসব যানবাহনে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেশি হওয়ার প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে দেশের ২২টি জাতীয় মহাসড়কে এসব যানবাহনসহ তিন চাকার যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

গত ২৫ নভেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি নিজেই অনুষ্ঠানে সড়ক দুর্ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, আমরা ২২টি জাতীয় মহাসড়কে এসব তিন চাকার যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু এনফোর্সমেন্টের দুর্বলতার কারণে এসব যানবাহন এখন জাতীয় মহাসড়কে চলাচল করছে। সড়কে দুর্ঘটনার হার কমলেও এসব যানবাহনের কারণে মৃত্যুহার বেশি হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সড়কমন্ত্রীর এমন পর্যবেক্ষণের পরও অননুমোদিত নছিমন, করিমন, আলমসাধু ও ভটভটির মতো দেশে তৈরি যানবাহন চলাচলের অনুমোদন দেওয়ার জন্য প্রক্রিয়া থেমে নেই। অথচ ২০১৫ সালে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে এসব নিষিদ্ধ যানবাহন আমদানি বন্ধের প্রস্তাব উঠেছিল। খসড়া নীতিমালায় অবশ্য মহাসড়কের অংশ বাদ দিয়ে বর্তমানে নিষিদ্ধ যানবাহনগুলো চলাচলের সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

এ সংক্রান্ত খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, অনুমোদিত মোটরযানের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক অপ্রচলিত ঝুঁকিপূর্ণ থ্রি-হুইলারসহ ছোট আকারের সমজাতীয় যানবাহন ব্যাপকহারে, অপরিকল্পিতভাবে সড়ক পরিবহন সেক্টরে যুক্ত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার ২০১৫ সাল থেকে ২২টি জাতীয় মহাসড়কে থ্রি-হুইলার অটোরিকশা, অটোটেম্পো ও সকল শ্রেণির অযান্ত্রিক বাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বিআরটিএ-তে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধিত ছিল ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ৪৯০টি মোটরযান। তার মধ্যে ভাড়ায় চালিত বাস ৪৯ হাজার ১৩টি (১.০১%) ও মিনিবাস ২৭ হাজার ৪৩৯টি (০.৫৬%)। অপরদিকে, অটোরিকশা ও অটোটেম্পো ৩ লাখ ১৯ হাজার ৫৬৯টি (৬.৫৬%), যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। 

পাশাপাশি সারাদেশে নিবন্ধনহীন বহু অননুমোদিত থ্রি-হুইলার, ইজিবাইক, নসিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু ইত্যাদি ছোট যান চলাচল করছে। এ সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছোট আকারের এসব অনিবন্ধিত ও অননুমোদিত যানবাহন কারিগরিভাবে সড়ক নিরাপত্তার জন্য উপযোগী নয়। এসব যানবাহনের নিরাপত্তা ইউনিট বিশেষ করে ব্রেক, বিয়ারিং সাসপেনশন মানসম্মত নয়। তাছাড়া ভারসাম্যহীন এ ধরনের যানবাহনের স্থায়ীত্বও কম। স্বল্প নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসম্পন্ন ধীরগতির এসব ছোট যানবাহন দ্রুতগতি সম্পন্ন মোটরযানের সঙ্গে একই মহাসড়কে চলাচলের সময় গতির পার্থক্য এবং নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে প্রায়শই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। 

বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সিংহভাগই ছোট ছোট মোটরযানের যাত্রী। সার্বিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের যানবাহন মহাসড়কে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। তবে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সাশ্রয়ী পরিবহন হিসেবে ব্যবহৃত এসব যানকে কারিগরিভাবে ত্রুটিমুক্ত করে অনুমোদিত ডিজাইন অনুসরণে নির্মাণ করা হলে নিরাপত্তা ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়। 

জানা গেছে, মহাসড়কে অপ্রচলিত ঝুঁকিপূর্ণ ছোট যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এবং এর কারিগরি মান উন্নয়নের মাধ্যমে স্থান বিশেষে চলাচলের বিষয়ে সুপারিশমালা প্রণয়নে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ইউছুব আলী মোল্লাকে আহ্বায়ক করে ২০১৯ সালের ২৩ জুন ১২ সদস্যের কমিটি করা হয়। গত ১০ জানুয়ারি ওই কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। এ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নের জন্য বিআরটিএ এর চেয়ারম্যানকে প্রধান করে খসড়া  নীতিমালা তৈরি করা হয় কমিটির সুপারিশমালার ভিত্তিতে।

খসড়া নীতিমালায় থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় যানবাহন বলতে অটোরিকশা (চালকসহ সর্বোচ্চ চার আসন বিশিষ্ট থ্রি-হুইলার), অটোটেম্পো (চালকসহ সর্বোচ্চ সাত আসন বিশিষ্ট থ্রি-হুইলার), ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক, পাখি), স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত করা থ্রি-হুইলার (নছিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু) ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে। 

খসড়া নীতিমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে, জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক ছাড়া অন্যান্য নির্দিষ্ট এলাকা/ রুটে রুট পারমিট নেওয়া সাপেক্ষে অটোরিকশা, অটোটেম্পো চলাচল করতে পারবে। সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকায় শহরের ভেতর অটোরিকশা ও শহরের বাইরে এবং উপজেলার নির্ধারিত রুটে অটোরিকশা ও অটো টেম্পো চলাচলের রুট পারমিট দেওয়া যাবে। আঞ্চলিক যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি (আরটিসি) নির্ধারিত সিলিং অনুসারে বিআরটিএ অটোরিকশা অটোটেম্পো নিবন্ধন দিতে পারবে। যাত্রী ও পরিবহন কমিটি সিলিং নির্ধারণ করবে। 

এ  সিলিং অনুযায়ী, অটোরিকশা ও অটো টেম্পো বিক্রি করতে হবে। ইজিবাইক ও পাখি উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থানীয় রুটে রুট পারমিট নিয়ে চলাচল করতে পারবে। 

খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিআরটিএ-র অনুমোদনক্রমে সিলিং অনুযায়ী ইজিবাইক, পাখি ইত্যাদি প্রস্তুত ও বিপণন করতে হবে এবং বিআরটিএকে এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান বার্ষিকভিত্তিতে সরকারকে অবহিত করতে হবে। রুট পারমিট পাওয়া ইজিবাইক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত ভাড়ায় চলাচল করবে। ইজিবাইক বা এ জাতীয় যানে অবশ্যই মান সম্পন্ন ব্যাটারি ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিভাগ অনুমোদিত ব্যাটারি চার্জিং নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। রুট পারমিটে উল্লেখিত রুটে স্টেইজ ক্যারিজ বা কন্ট্রাক্ট ক্যারিজ হিসেবে ইজিবাইক চলাচল করতে পারবে। খসড়া নীতিমালায় নছিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু ইত্যাদি মোটরযান ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের স্থানীয় রুটে রুট পারমিট গ্রহণ সাপেক্ষে নসিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু ও এ জাতীয় বাহন চলাচল করতে পারবে। তবে উক্ত রুটের কোনো অংশ মহাসড়ক বা আঞ্চলিক মহাসড়কের অংশ হতে পারবে না। উপজেলা সড়ক নিরাপত্তা কমিটির মতামতের ভিত্তিতে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি রুট নির্ধারণপূর্বক সে অনুযায়ী রুট পারমিট দেবে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি (আরটিসি) নির্ধারিত সিলিং অনুযায়ী বিআরটিএ নছিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু ইত্যাদি বাহনের নিবন্ধন দেবে। নসিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু ইত্যাদির রেজিস্ট্রেশন ও সিলিং নির্ধারণের আগে এ ধরনের বাহনের সর্বজন গ্রাহ্য এবং যাত্রী সুরক্ষার ব্যবস্থা সম্বলিত অনুমোদিত ডিজাইন/ ড্রইং নির্ধারণ করতে হবে-যেকোনো সরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারিশ সাপেক্ষে বিআরটিএ কর্তৃক টাইপ অনুমোদিত হতে হবে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি (আরটিসি) সিলিং নির্ধারণ করবে এবং উক্ত সিলিং অনুযায়ী নসিমন, করিমন,ভটভটি, আলমসাধু ইত্যাদি বাহন প্রস্তুত বা বিক্রয় করতে হবে। রুট পারমিট পাওয়া নসিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু ইত্যাদি বাহন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত ভাড়ায় চলাচল করবে। নসিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু ইত্যাদি বাহন রুট পারমিটে উল্লেখিত রুটে স্টেইজ ক্যারিজ বা কন্ট্রাক্ট ক্যারিজ হিসেবে চলাচল করতে পারবে।

খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, এ নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন সনদ, হালনাগাদ রুট পারমিট, ফিটনেস সনদ, ট্যাক্স টোকেন প্রয়োজন হবে। এ নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় যানবাহন শুধু রুট পারমিটে উল্লেখিত এলাকায় চলাচল করতে পারবে। 

পিএসডি/এইচকে