নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ইউপি নির্বাচনে ভোট গণনার শুরু থেকে একের পর এক খবর আসতে থাকে চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. মারুফ হোসেন ওরফে অন্তিক নিকটতম প্রার্থীর থেকে পিছিয়ে পড়ছেন। এ সময় মারুফ সমর্থকদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন তাকে নির্বাচনে জয়ী হতে হলে নিজ এলাকার কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দিতে হবে।

কেন্দ্র দখল ও জাল ভোট দেওয়ার জন্য প্রিজাইডিং অফিসারকে অনুরোধ করলে তিনি রাজি হননি। এতে মারুফের সমর্থকরা ক্ষিপ্ত হয়ে প্রিজাইডিং অফিসারসহ নির্বাচনী কর্মকর্তাদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিতে চেষ্টা করে এবং তাদের লাঞ্ছিত করে। বিষয়টি তখন উপজেলা রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানালে তিনি ভোট বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন।

পরে নিয়ম অনুযায়ী বিকেলের পর ভোট গণনা শুরু হলে মারুফের লোকজন আবার কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কেন্দ্রে বিজিবির টহল টিম আসে। কিন্তু এতেও মারুফের সমর্থকরা ক্ষ্যান্ত হয়নি। তারা বিজিবির সদস্যদের ওপর হামলা করে। গত ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনের দিন নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী মারুফের সমর্থকদের হামলায় বিজিবি সদস্য নায়েক রুবেল হোসেন নিহত হন।

এ ঘটনায় কিশোরগঞ্জ উপজেলায় গড়াগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম দলিরাম মাঝাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ললিত চন্দ্র রায় গত ৩০ নভেম্বর মো. মারুফ হোসেনকে প্রধান আসামিকে ৯৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার পর থেকে র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু ঘটনার পর থেকে মামলার মূল আসামি মারুফ আত্মগোপনে ছিলেন।

সর্বশেষ সোমবার (১৩ অক্টোবর) সাভারের আশুলিয়া থেকে মারুফকে গ্রেফতার করে র‍্যাব-৪ এর একটি দল।

মঙ্গলবার (১৪ ডিসেম্বর) দুপুরে কারওয়ান বাজারে অবস্থিত র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব কথা জানান।

তিনি বলেন, গ্রেফতার মো. মারুফ হোসেন কিশোরগঞ্জ উপজেলায় গড়াগ্রাম ইউনিয়নের ইউপি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। তার বাবা মোসাদ্দেক হোসেন একই ইউনিয়নে ১৯ বছর ধরে চেয়ারম্যান ছিলেন। তার বাবা ২০১৭ সালে মৃত্যুবরণ করলে তিনি উপ-নির্বাচনে জয়ী হন।

নির্বাচনের দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে র‍্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, মারুফ পরিসংখ্যান ও তথ্য নিয়ে দেখেন নির্বাচনে জয়ী হতে হলে নিজ কেন্দ্র পশ্চিম দলিরাম মাঝাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সব ভোট তার প্রয়োজন। তাই ওই কেন্দ্রের সব ভোট নিজের দখলে নেওয়ার জন্য পেশীশক্তি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। মারুফ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে থেকেই কেন্দ্র দখল এবং প্রয়োজনে হামলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভোট চলাকালে বিকেল ৩টায় মারুফের ২০/৩০ জন সমর্থক জাল ভোট দেওয়ার জন্য কেন্দ্রে প্রবেশ করে। তখন দায়িত্বরত পুলিশ ও নির্বাচনী কর্মকর্তারা তাদের বের করে দেওয়ার চেষ্টা করলে মারুফের সমর্থকরা সংশ্লিষ্টদের গালাগালসহ লাঞ্ছিত করে। পরে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার বিষয়টি উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে জানালে তিনি ভোট বন্ধ করার নির্দেশ দেন।

তিনি বলেন, পরে বিকেল সাড়ে ৪টায় ভোট গণনা শুরু হয়। ইতোমধ্যে অন্য আটটি কেন্দ্রের ফলাফল বিশ্লেষণে মারুফ নিকটতম প্রার্থীর ভোটের তুলনায় সামান্য পিছিয়ে রয়েছে বলে জানতে পারেন। তাই তিনি নিজ এলাকার কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দেওয়ার জন্য প্রিজাইডিং অফিসারকে আটকে রেখে চাপ দিতে থাকেন। প্রিজাইডিং অফিসার অপারগতা প্রকাশ করলে তিনিসহ তার প্রায় শতাধিক সমর্থকসহ বিভিন্ন ধারাল দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রিজাইডিং অফিসার, নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ, কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা করে। এ হামলার ঘটনার কেন্দ্রটিতে বিজিবির একটি দল টহল দিতে আসে। পরে আবার রাত সাড়ে ৮টায় মারুফ হোসেন ও তার সমর্থকরা ধারাল অস্ত্র নিয়ে বিজিবি সদস্যদের ওপর চড়াও হয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে গুরুত্বর জখমের ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নায়েক রুবেল ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন।

এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, ইউপি নির্বাচন বেশ কয়েকটি ধাপে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে র‍্যাবও দায়িত্ব পালন করেছে। নির্বাচনী কেন্দ্রের বাইরে এলিট ফোর্স হিসেবে কাজ করেছে। উপজেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার নির্দেশক্রমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে আমরা নির্বাচনী নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করি। ইউপি নির্বাচনে গ্রাম পর্যায়ে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সেগুলো নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা সেভাবে ফোর্স মোতায়েন করেছি। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় কোনো প্রার্থী তার নিজের কেন্দ্রে জয়ী হওয়ার জন্য গ্রামের লোকজন জড়ো করে সহিংসতার চেষ্টার করে বা করে। সেক্ষেত্রে অনেক সময় এ ধরনের নির্বাচনী সহিংসতা জন্ম নেয়। এসব ঘটনায় আমরা সহিষ্ণুতার পরিচয় দেয়। অপচেষ্টাকারী উত্তেজিত জনতাকে আমরা সহিংসতা না করার জন্য বোঝানোর চেষ্টার করি।

এমএসি/এসএসএইচ