২০২১ সালে জাহাজ-ভাঙা শিল্পে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ১২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে এবং আহত হয়েছেন ৩০ জন। আর ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে কমপক্ষে ১১০ জন মারা গেছেন এবং দুই শতাধিক মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। তাদের অধিকাংশই স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

আজ রোববার (২৬ ডিসেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত এক মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে এ তথ্য জানান জাহাজ-ভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরাম নেতারা।

২৫ ডিসেম্বর সীতাকুণ্ড উপজেলার শীতলপুরে অবস্থিত যমুনা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে ৪ শ্রমিক আহত হওয়া এবং বিভিন্ন সময়ে জাহাজ-ভাঙা শিল্পে দুর্ঘটনায় শ্রমিক নিহত হওয়ার প্রতিবাদে এই মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। 

এ সময় বক্তারা বলেন, জাহাজ-ভাঙা শিল্পে বারবার দুর্ঘটনা ঘটলেও মালিক ও সরকার নির্বিকার। কেবল ২০২১ সালেই এই শিল্পে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ১২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। 

জাহাজ-ভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের কোষাধ্যক্ষ রিজওয়ানুর রহমান খানের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন জাহাজ-ভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের আহ্বায়ক তপন দত্ত, বিলস-এর সিনিয়র কর্মকর্তা পাহাড়ি ভট্টাচার্য, বিএফটিইউসি চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক শ্রমিকনেতা কে এম শহিদুল্লাহ, জাহাজ-ভাঙা শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ ইদ্রিছ। সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন পরিবহন শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি উজ্জ্বল বিশ্বাস, হাসিবুর রহমান বিপ্লব, মো. পারভেজ প্রমুখ। 

সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন টিইউসি চট্টগ্রাম জেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ইফতেখার কামাল খান এবং জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুর রহমান মজুমদার। মানববন্ধন কর্মসূচি সঞ্চালনা করেন বিলস কর্মকর্তা ও  শ্রমিকনেতা ফজলুল কবির মিন্টু।

এ সময় নেতৃবৃন্দ বলেন, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে কমপক্ষে ১১০ জন শ্রমিক মারা গেছেন জাহাজ-ভাঙা শিল্পে। এছাড়া দুই শতাধিক শ্রমিক মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশ স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। 

নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, ২০২১ সালে ১২ জন শ্রমিক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন এবং ৩০ জনের বেশি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। বছরের পর বছর জাহাজ-ভাঙা শিল্প খাতে দুর্ঘটনা এবং শ্রমিকের মৃত্যুর হার ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেলেও দায়ী মালিক বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
 
নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী জাহাজ কাটার আগে বর্জ্য, বিষাক্ত গ্যাস এবং বিস্ফোরক মুক্ত করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। ভৌগলিক সুবিধার কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ বড় জাহাজ এখানে কাটা হয়। কিন্তু বড় জাহাজ কাটার জন্য যে ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা প্রয়োজন অধিকাংশ ইয়ার্ডে তা ব্যবহার করা হয় না। শ্রম আইনের ৯০(ক) ধারা মতে সেফটি গঠন বাধ্যতামূলক হলেও এখনো পর্যন্ত কোনো ইয়ার্ডে সেফটি কমিটি গঠন করা হয়নি। ফলে প্রতিনিয়ত মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকেরা কাজ করছে। জাহাজ-ভাঙা শ্রমিকদের কর্মস্থান আজ কবরস্থানে পরিণত হয়েছে। যার সর্বশেষ শিকার যমুনা শিপ ইয়ার্ডের ৪ জন হতভাগ্য শ্রমিক।  

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো সুবিধাও জাহাজ-ভাঙা শ্রমিকেরা পাচ্ছেন না। ২০১৮ সালে মজুরি বোর্ডের রোয়েদাদ অনুযায়ী এই সেক্টরের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি মাসিক ১৬ হাজার টাকা এবং দৈনিক ৬১৫ টাকা। মজুরি বোর্ডের রোয়েদাদ কার্যকর করা শ্রম আইনের ১৪৮ ধারা অনুযায়ী বাধ্যতামূলক হলেও মালিকেরা তা মানছেন না। জাহাজ-ভাঙা শিল্পের মালিকরা এত বেশি প্রভাবশালী যে, তারা একের পর এক অনিয়ম করে গেলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার মতো সাহস সরকারি কর্মকর্তারা দেখাতে পারেন না।  

এ সময় নেতারা অভিযোগ করে বলেন, রাতের বেলায় কাজ না করার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও মালিকেরা তা মানেন না। শ্রমিকেরা এখনো দৈনিক মাত্র ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজ করে থাকেন। শ্রমিকদের উৎসব বোনাসও দেওয়া হয় না। অনেক ইয়ার্ডে সময়মতো মজুরিও পাওয়া যায় না। এত অনিয়ম,অবিচার ও নির্যাতন সহ্য করেও শ্রমিকেরা প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। জাহাজ-ভাঙা শিল্প আজ এক চরম অনিরাপদ কর্মক্ষেত্রে উপনীত হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য রাষ্ট্র বা মালিকের যেন কোনো দায় নেই।  

নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, মালিকেরা ব্যবসা এবং মুনাফা বোঝে কিন্তু শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা বোঝে না। রাষ্ট্র এবং মালিকদের এমন নির্লিপ্ততা আর মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত জাহাজ-ভাঙা ইয়ার্ডে যদি আর একজন শ্রমিকও আহত বা নিহত হন তা দেশের শ্রমিকেরা মেনে নেবে না। 

মানববন্ধন শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল শহরের মূল মূল সড়ক প্রদক্ষিণ করে।

কেএম/এইচকে