বাংলা ভাষার দাবিতে প্রাণদানের গৌরবোজ্জ্বল মাতৃভাষা আন্দোলনের আজ ৭০ বছর পূর্ণ হলো

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলা ভাষার দাবিতে প্রাণদানের গৌরবোজ্জ্বল মাতৃভাষা আন্দোলনের আজ ৭০ বছর পূর্ণ হলো। 

দিবসটি উপলক্ষে ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে গোটা জাতি। একুশের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল সালাউদ্দিন ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানান। এরপর সর্বস্তরের মানুষ ভাষা শহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

প্রাপ্ত বয়স্কদের পাশাপাশি ভোর থেকে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় শিশুরাও। বাবা-মায়ের হাত ধরে এসেছে তারা। সন্তানের বায়নার কাছে হার মেনে শহীদ মিনারে এসেছেন অনেক অভিভাবক।

ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে আসা শিশুদের একজন লালবাগ সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ঐশী ইসলাম। শহীদ মিনারে আসতে পেরে বেশ খুশি ঐশী জানায় এখানে এসে তার খুব ভালো লাগছে।

তার বাবা জাকিরুল ইসলাম হিমেল বলেন, আমার মেয়েকে ভাষা শহীদদের সম্পর্কে জানাতে শহীদ মিনারে নিয়ে এসেছি। বইয়ের ভাষা বা শিক্ষকদের মুখে যতটুকু শুনেছে, তা আরেকটু শানিত করার জন্য তাকে এখানে নিয়ে এসেছি। নিজ চোখে শহীদ মিনার দেখবে, এখান থেকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো শিখবে সে।

এখান থেকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো শিখবে শিশুরা। শ্রদ্ধা জানানোর পর জানালেন একজন অভিভাবক

উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রূপনীল বিশ্বাস বলল, আমার অনেক ভালো লাগছে। এই শহীদ মিনারটা আমরা বইয়ে দেখেছি। আজ সরাসরি দেখলাম।

রূপনীলের বাবা রূপক কান্তি বিশ্বাস বলেন, আমি আজ অন্য একটা কাজে ব্যস্ত ছিলাম। ছেলে বায়না ধরেছে শহীদ মিনারে আসবেই, কান্না শুরু করে দিয়েছিল। তাই তাকে নিয়ে এসেছি। এখানে আসার পর মনে হয়েছে, একুশের চেতনা বৃথা যাবে না কোনো দিন।

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী রুবায়েত ইসলাম ও তার ছোট বোন মাহিয়া ইসলাম শহীদ মিনারের মূল বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। রুবায়েত ইসলামের কাছে ভাষা শহীদ কারা জিজ্ঞেস করতেই এক নিঃশ্বাসে সবার নাম বলে দিলো। তার বোন মাহিয়াও জানাল, এখানে এসে ওর খুব ভালো লাগছে।

‘আমরা বিদেশি ভাষা রপ্ত করায় বেশি ব্যস্ত’ 
সকাল থেকে দলে দলে মানুষ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মূল বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। তাদেরই একজন সাকিব হাসান, মিরপুর থেকে এসেছেন তিনি। সাকিব বলেন, প্রথমবার বান্ধবীকে নিয়ে এসেছি, ভালো লাগছে। একসাথে ফুল দিয়েছি শহীদ মিনারের বেদিতে। এটাই ‘স্পেশাল’ আমার জন্য। সামনের বছরগুলোতেও হয়তো আসা হবে।

তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরেও বাংলা ভাষাকে আমরা সর্বস্তরে ব্যবহার করি না। আমরা শুদ্ধ করে নিজ ভাষা বলতে পারি না। অথচ ইংরেজি, হিন্দির মতো বিদেশি ভাষাগুলো রপ্ত করায় বেশি ব্যস্ত থাকি।  

সাকিব হাসানের সঙ্গে আসা শারমিন জাহান বলেন, ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এর আগে স্থানীয় শহীদ মিনারে গিয়েছি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এবারই প্রথম এলাম। অনুভূতি অন্যরকম। অনেক মানুষ এখানে, ভালোই লাগছে। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বাংলার চেয়ে ইংরেজিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আমার মনে হয় প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সর্বত্র বাংলার চর্চা আরও বাড়ানো দরকার। 

পলাশী এলাকা থেকে সস্ত্রীক শহীদ মিনারে আসেন মো. সাব্বির আহমেদ। তিনি বলেন, এর আগে বেশ কয়েকবার বন্ধুদের সাথে এসেছি। এবার এলাম স্ত্রীকে নিয়ে। তাই বেশি ভালো লাগছে। ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি। তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছি। 

মাতৃভাষা বাংলার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন শহীদরা। কিন্তু তারপরও আমরা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারি না। আক্ষেপের সুরে বললেন শ্রদ্ধা জানাতে আসা ফারহানা

তার স্ত্রী ফারহানা বলেন, আমি গ্রামে থাকি। এবারই প্রথম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এলাম, তাও আবার স্বামীর সঙ্গে। এখানে অনেক মানুষ, সবাই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। এটা দেখে ভালো লাগছে। আমি প্রতি বছরই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এখানে আসতে চাই।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, মাতৃভাষা বাংলার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন শহীদরা। কিন্তু তারপরও আমরা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারি না। বাংলার চেয়ে বিদেশি ভাষার প্রতি আগ্রহ বেশি আমাদের। আবার অনেকে এই দিনটাকে উৎসব মনে করে। অথচ আমরা এখানে শোক ও শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। 

শ্রদ্ধা জানাতে আসা রাব্বী বলেন, ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরে একটাই প্রত্যাশা, দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার চর্চা বাড়ুক। 

ইসরাত জাহান নামে এক তরুণী বলেন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এবারই প্রথম এসেছি। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। এখানে অনেক মানুষ দেখে ভালো লাগছে। কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখব, তারপর চলে যাব।

এএজে/এনএফ/জেএস