ছবি : সংগৃহীত

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ৪ শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছে ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনায়ও ছাত্রলীগের নাম। সেপ্টেম্বরে ইডেন কলেজে যে ঘটনা ঘটল, সেখানেও ছাত্রলীগ। বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত ছাত্রলীগ (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)।

ছাত্রীর আর্তনাদে উল্লাস করে নির্যাতনকারীরা (যুগান্তর, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। ছাত্রলীগ নেত্রীর নির্যাতন, পেটালেন, বঁটি নিয়ে তেড়ে এলেন, পরে বললেন, ‘মহুয়া আমার ছোট বোন’ (প্রথম আলো, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। ইবির হলে ছাত্রী নির্যাতন সানজিদাসহ ৫ নেতাকর্মীকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার (ঢাকা পোস্ট, ০১ মার্চ ২০২৩)।

এই রকম অসংখ্য শিরোনামে মুখর গণমাধ্যম। ছাত্রলীগের মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচারে পর্যুদস্ত সাধারণ শিক্ষার্থী। এমন জঘন্য ঘটনা কি আর কোথাও ঘটে?

পৃথিবীতে বাংলাদেশ ব্যতীত এমন আরেকটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলুন যে দেশের শিক্ষার্থীরা পড়তে এসে আবাসিক হলে তারই শিক্ষকদের প্রচ্ছন্ন তত্ত্বাবধানে তারই সহপাঠীদের দ্বারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়। উদাহরণ নেই।

কেউ যদি জানে, সে কোনো অন্যায় করলে বিচার হবে না, প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না, যদি কখনো কিছু করে সেটাও হবে লোক দেখানো, কিছুদিন পরে আবার সেটা উঠে যাবে, তখন তো সে যা ইচ্ছে তাই করবে। এরকম বার্তা যখন কোনো সংগঠনের মধ্যে থাকে, তাহলে সেই সংগঠনের সদস্যরাও যা ইচ্ছে তাই করবে। সেজন্যই আজকে সারা বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে।

অপরাধমূলক ঘটনা যখন ঘটে, তখন দৃষ্টান্তমূলক বিচার বা শাস্তি হতে দেখা যায়নি। যদিও মানুষকে দেখানোর জন্য মাঝেমধ্যে বিচার করার চেষ্টা করে, কিন্তু, এটা কেবল চোখে ধুলা দেওয়া। প্রকৃতপক্ষে তাদের বিচার হয় না।

পৃথিবীতে বাংলাদেশ ব্যতীত এমন আরেকটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলুন যে দেশের শিক্ষার্থীরা পড়তে এসে আবাসিক হলে তারই শিক্ষকদের প্রচ্ছন্ন তত্ত্বাবধানে তারই সহপাঠীদে

মানুষ যখন ভুলে যায়, সেই বিচার আর হয় না। নানা অপকর্মের একটার বিচারও কি আজ পর্যন্ত হয়েছে? কিছুদিন আগে ইডেন কলেজে যা ঘটল, পত্রিকায় অনবরত সব এসেছে, সেগুলোর কোনো বিচার হয়েছে?

এগুলোর বিচার তো হয়ই না, উল্টো শিক্ষকরা চেষ্টা করে কীভাবে ওদের অন্যায় ঢেকে রাখা যায়। অন্যথায় শিক্ষকরা তো পদ-পদবি পাবে না। এমন পরিস্থিতিতে এই ধরনের অন্যায় তো ঘটতেই থাকবে। বরং দিনকে দিন এর মাত্রা আরও বাড়তেই থাকবে।

বিদ্যমান শিক্ষার্থীদের মানসম্মত আবাসিক ব্যবস্থার সমাধান না করে, লেখাপড়া ও গবেষণার পরিবেশ তৈরি না করে, ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে বছর বছর নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অর্থ কি?

এর অর্থ হলো স্বল্পমেয়াদে বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা। এর অর্থ হলো বেশি করে সরকারি দলের কর্মী নিয়োগের চেষ্টা। এর অর্থ হলো সেই কর্মীদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করা। এর অর্থ হলো একটা অশিক্ষিত-কুশিক্ষিত জাতি গড়ে তাদের ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া। মনে রাখতে হবে ‘ইতর প্রাণী প্রসব করে বেশি।’

ধরুন, আপনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভিক্ষুককে ১০০০ টাকা দান করবেন। আপনি কি ১ টাকা করে ১০০০ জনকে দিয়ে ১০০০ জনকে খুশি করবেন? নাকি ৫০ টাকা করে দিয়ে ২০ জনকে বা ১০০ টাকা করে দিয়ে ১০ জনকে খুশি করবেন? ১ টাকা করে ভিক্ষুককে দিলে আজকালকার ভিক্ষুক নিবেই না। নিলেও খুশি হওয়ার বদলে গালি দেবে।

...মানুষ যখন ভুলে যায়, সেই বিচার আর হয় না। নানা অপকর্মের একটার বিচারও কি আজ পর্যন্ত হয়েছে? কিছুদিন আগে ইডেন কলেজে যা ঘটল, পত্রিকায় অনবরত সব এসেছে, সেগুলোর কোনো বিচার হয়েছে?

আমরা বাংলাদেশের জনগণ ভিক্ষুকদের চেয়েও অধম। যেই বরাদ্দ দিয়ে ১টা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথা সেই বরাদ্দ দিয়ে আমরা ১০টা বিশ্ববিদ্যালয় খুলছি। এতে কী হচ্ছে? একটিও বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে না। যেই বেতন ও গবেষণার সুযোগ দিচ্ছি তাতে ভালো শিক্ষকও নিয়োগ হচ্ছে না আর গবেষণাও হচ্ছে না। কিন্তু জেলায় জেলায় নামমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে।

শুনতে পাই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক হয় প্রধান অতিথি আর সেই জেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয় অতিথি বা বিশেষ অতিথি। এমনকি কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও এটি ঘটতে দেখলাম। এইবার বুঝুন কেমন মানুষদের আমাদের সরকার ভিসি বানায়?

বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি বিশ্ববিদ্যালয় বানালে একটি দেশ বদলে যেতে পারে। উদাহরণ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর। উদাহরণ অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। পৃথিবীতে এখনো ইংল্যান্ড এত সভ্য এবং ক্ষমতাধর হওয়ার পেছনের কারণ এইসব বিশ্ববিদ্যালয়।

একই কথা বলা চলে আমেরিকার ক্ষেত্রে। আমাদের দেশ এত অপরিষ্কার, এত ট্র্যাফিক জ্যাম, এত দূষণ, এত দুর্গন্ধ, এত অপরিকল্পনার কারণ শিক্ষা।

পৃথিবীর অনেক দেশ কত এগিয়ে যাচ্ছে আর আমরা রাস্তার ট্রাফিক ব্যবস্থা এখনো অটোমেটেড করতে পারলাম না। এই একটি ব্যর্থতাই প্রমাণ করে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই বিশ্বে আমরা কতটা পেছনে।

আমাদের আরও পিছিয়ে দেওয়ার জন্য এখন আমাদের স্কুলগুলো টার্গেট করা হয়েছে। এই উদ্দেশ্যেই নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হচ্ছে যেন আমরা কোনোদিন শিক্ষিত উন্নত দেশ না হই। আমরা যেন আরেকটা দক্ষিণ কোরিয়া বা চীন কিংবা জাপান না হয়ে যাই। এভাবে আর কতদিন?

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়