ছবি : সংগৃহীত

উচ্চ তাপমাত্রায় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে কৃষিসহ গবাদি পশু খাত। দেশব্যাপী তাপমাত্রা বাড়ার কারণে ক্ষতি হচ্ছে ধান, আম, লিচু ও তুলাসহ অন্যান্য ফসলের। ক্ষতি হচ্ছে গবাদি পশুরও। এইসব বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন।

ধানের জন্য ৩৫ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা অসহনীয়, দেশে চলছে ৪০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা! যা সার্বিক ধান উৎপাদন এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বড় অন্তরায়! এই অতি তাপদাহে ধান ছাড়াও অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। ভুট্টা ও সয়াবিন উৎপাদনেও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

চলতি মৌসুমে সর্বোচ্চ এবং বিগত ৫৮ বছরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এই তাপমাত্রা সার্বিক কৃষির জন্যই অসহনীয়! এই বছর অস্বাভাবিক গরম পড়ছে। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ খুবই কম। অতি খরা, অতি উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ফসলের উৎপাদন ৩০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ কমে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

আরও পড়ুন >>> কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার 

ইতিমধ্যে কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বৈরী আবহাওয়ায় কীভাবে ভালো ফসল উৎপাদন করা যায় তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। অন্যদিকে গাছপালা উজাড় করা হয়েছে। সবুজ আচ্ছাদন হারিয়ে নগরায়ন ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলেছে।

এই তাপদাহ কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও দায়ী বলে মনে করেন গবেষকরা। এছাড়া সারা দেশের পুকুর, খাল-বিল জলাশয় অপরিকল্পিতভাবে ভরাট এবং দখলের মহাউৎসব চলেছে—যার বৈরী ভাব ফসলে পড়েছে। 

ফসলের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে—

দাবদাহে ধান ফসলের ব্যবস্থাপনা 

বোরো ধানে হিটশক (তাপজনিত ক্ষতি) বা গরম বাতাস (৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস +) প্রবাহ হলে ধান চিটা হতে পারে। তাই জমিতে ২-৩ ইঞ্চি পানি কাইচথোর (Panicle Stage of Rice) থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত ধরে রাখতে হবে।

চলতি মৌসুমে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এই তাপমাত্রা সার্বিক কৃষির জন্যই অসহনীয়! অতি খরা, অতি উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ফসলের উৎপাদন ৩০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ কমে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ধান গাছের ফুল অবস্থায় সাতটা থেকে এগারোটা পরাগায়নের সময়, এই সময় কোনো প্রকার বালাইনাশক স্প্রে করা যাবে না। ধান যাতে চিটা না হয় সেজন্য এমওপি সার দশ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম মিশিয়ে ৫ শতাংশ হিসেবে স্প্রে করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন >>> ধানের ব্লাস্ট রোগের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা 

তাপপ্রবাহের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য জলবায়ু সহনশীল তাপ প্রতিরোধী নতুন ধানের জাত ব্রি ৮৯ এবং ব্রি ৯২ জাতের ধান চাষ করা যেতে পারে। 

দাবদাহে ফল-ফসলের ব্যবস্থাপনা

আম, কাঁঠাল এবং লিচু গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত (৭ থেকে ১০ দিন অন্তর) সেচ প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে গাছের শাখা-প্রশাখায় পানি স্প্রে করে দিতে হবে। প্রয়োজনে প্লাবন পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া যেতে পারে। এতে ফল ঝরে পড়া কমবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া মাটিতে রস ধরে রাখার জন্য সেচের পর গাছের গোড়ায় মালচিং (বিভিন্ন ধরনের বস্তু দিয়ে যখন গাছপালার গোড়া, সবজি ক্ষেত ও বাগানের বেডের জমি বিশেষ পদ্ধতিতে ঢেকে দেওয়া হয় তখন তাকে বলে মালচ। আর এই পদ্ধতিকে বলে মালচিং।) দেওয়া যেতে পারে। 

দাবদাহে সবজি ফসলের ব্যবস্থাপনা

ফল এবং পাতা জাতীয় সবজির জমিতে আগামী এক সপ্তাহে মাটির ধরন বুঝে প্রয়োজনীয় দুই থেকে তিনটি সেচ ব্যবস্থা করতে হবে। জৈব সারের পানি ধারণ ক্ষমতা বেশি, তাই জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।

আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধু : দরিদ্রজনের সখা

ফল এবং সবজির চারাকে তাপপ্রবাহের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য মালচিং ও সেচ নিশ্চিত করতে হবে। চলমান তাপপ্রবাহের কারণে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি নিরসনে স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিতে হবে।

দাবদাহে প্রাণীসম্পদ ব্যবস্থাপনা

প্রাণীসম্পদের তাপপ্রবাহজনিত পীড়ন (স্ট্রেস) সহনশীল করতে, গবাদি প্রাণী, পোলট্রির ঘর শীতল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। গবাদি প্রাণীকে দিনে একাধিকবার গোসল করিয়ে দিতে হবে অথবা পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে।

গবাদি পশুকে পানির সাথে অতিরিক্ত লবণ ভিটামিন সি (Vitamin C) এবং গ্লুকোজ (Glucose) ইত্যাদি মিশিয়ে খেতে দিতে হবে। তাপদাহের এই সময় গবাদি পশুকে ঘরে আবদ্ধ না রেখে গাছ বা প্রাকৃতিক ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে।

সারা দেশের পুকুর, খাল-বিল জলাশয় অপরিকল্পিতভাবে ভরাট এবং দখলের মহাউৎসব চলেছে—যার বৈরী ভাব ফসলে পড়েছে।

গবাদি পশুকে এই সময় শুকনো খড় না দিয়ে কচি সবুজ ঘাস খেতে দিতে হবে। অতি তাপদাহে খাবার কমিয়ে দিতে হবে। প্রচণ্ড গরমের সময় গবাদি পশুকে কৃমিনাশক, টিকা কিংবা প্রাণী পরিবহন পরিহার করতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি হলে স্থানীয় প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে হবে। 

দাবদাহে মৎস্য-সম্পদ বাঁচাতে ব্যবস্থাপনা

তুলনামূলক কম গভীরতার পুকুরে নতুন পানি যোগ করে গভীরতা কমপক্ষে ৫ ফুট করতে হবে যাতে নিচের পানি কিছু ঠান্ডা থাকে এবং মাছ সেখানে থাকতে পারে। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে পানির মধ্যে মাচা করে লাউ জাতীয় গাছ লাগিয়ে পুকুরে ছায়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন >>> আমার গ্রাম, আমার শহর

পুকুরের মোট আয়তনের ১০ শতাংশ জায়গায় চারদিকে বাঁশের ঘেরাও দিয়ে কচুরি পানা / নারকেল গাছের পাতা রাখা যেতে পারে।  দিনেরবেলায় রোদের সময় অর্থাৎ দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত গভীর নলকূপ থেকে পানির সরবরাহ করে কমপক্ষে ৫ ফুট বা তার বেশি পানির উচ্চতা বজায় রাখতে হবে।

সকালবেলায় শতকে ২০০- ২৫০ গ্রাম লবণ বা ১০০ গ্রাম ভেট স্যালাইন গুলিয়ে পুকুরে ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। রাতের বেলায় এরেটর (Aerator) / ব্লোয়ার (Blower) মেশিন চালিয়ে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে অন্যথায় শতকে ১০ গ্রাম হারে অক্সিজেন ট্যাবলেট পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।

পুকুরের পানি স্বাভাবিক ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত পুকুরে খাবার সরবরাহ কমিয়ে দিতে হবে বা প্রয়োজনে সাময়িক বন্ধ রাখতে হবে। সকালে এবং সন্ধ্যার পর খাবার অল্প করে দিতে হবে।

ভিটামিন সি মিশিয়ে (৭-৮ গ্রাম/কেজি) খাদ্যের সাথে খাওয়াতে হবে তাপমাত্রা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত। এই সময় দিনেরবেলায় মাছ/পোনা স্থানান্তর বন্ধ রাখতে হবে বা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করতে হবে। 

সমীরণ বিশ্বাস ।। কৃষিবিদ
srb_ccdbseed@yahoo.com