কঠোর নিষেধাজ্ঞায় দেশ। সরকারের যে নির্দেশনা তাতে রাস্তায় বের হওয়ার অনেক ফাঁক-ফোকর আছে। অনেকটা এমন ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’। এই ব্যাপারে হুঙ্কার আছে; সাথে শিথিলতাও আছে। বলা যায়, অদ্ভুত এক নিষেধাজ্ঞায় দেশ। সরকারি নির্দেশনায় বলা হয়েছে বই মেলা চলবে, শিল্পকারখানা চলবে, ব্যাংক অফিস চলবে। প্রশ্ন হলো, এসব কাদের জন্য চালু থাকবে? জনসাধারণের জন্য? আবার বলা হয়েছে গণপরিবহন চলবে না। কীভাবে মানুষ সেসব জায়গায় যাবে? ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে? উড়ে উড়ে! আমি গতকাল আমার হাসপাতালে ঠিকই গিয়েছিলাম। রূপগঞ্জে গিয়ে করোনায় মারা যাওয়া দুই ব্যক্তির দাফন কাফনের ব্যবস্থা করলাম। নিজের গাড়ি ছিল তাই পথে যানজট ছাড়া সমস্যা হয়নি আমার। যাদের নিজস্ব গাড়ি নেই তারা কর্মস্থলে কীভাবে যাবেন? পায়ে হেঁটে কিংবা ৩/৪ গুণ বাড়তি টাকা গুনে তবেই যেতে হয়েছে। আসলে গরিবের যত জ্বালা।

৫ এপ্রিল থেকে কঠোর নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে। সেদিন সকালে করোনায় মৃত আমার ব্যবসায়িক পার্টনার আরমানুজ্জামান ভাইয়ের জানাজায় যাওয়ার পথে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রূপগঞ্জে এক ঘণ্টা সড়কে আটকে পড়ি। জানাজার সময়ও ঘনিয়ে আসছে। গাড়ির ভেতরে ছটফট করছি আমি। এ অবস্থায় আমার ড্রাইভার বিল্লাল বলে উঠে, স্যার সেইরাম লকডাউন।

অন্যদিনের চেয়ে সড়কে গাড়ি বেশি। রাস্তায় শ্রমিক কর্মচারীদের বিশাল লাইন। চলতে গিয়ে বাজারে বাজারে মানুষের জটলা দেখলাম। এটা নাকি কঠোর নিষেধাজ্ঞা! এদেশে সব কিছুই আসলে উল্টো পথে চলে।

কঠোর নিষেধাজ্ঞায় সরকারের ক্ষতি বেশি। দেশের অর্থনীতির চাকা অচল, তা সামাল দিতে সরকারকে হিমশিম খেতে হয়। মানুষের জীবনতো আগে তাই কঠোর নিষেধাজ্ঞায় যেতে হয়েছে সরকারকে।

দ্রব্যমূল্যের কি অবস্থা? এদেশের মানুষগুলোও বেশ অদ্ভুত। টাকা আছে তাই হুড়মুড় করে বাজার থেকে প্রয়োজনের তুলনায় ৪/৫ গুণ বেশি খাদ্যদ্রব্য কিনে ঘরে মজুত করে। এবার কঠোর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পরও তাই দেখেছি আমরা। ফলে বাজারে পণ্যের সংকট তৈরি হয় আর তাতে পণ্যের মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। আর দেশের মজুতদাররাও এসময় দাম বাড়িয়ে দেয়। দৈনিক আয়ের মানুষগুলো কষ্টে পড়ে তাতে।

আসলে আমরা সতর্ক নই বললেই চলে। কঠোর নিষেধাজ্ঞায় হাটবাজার পুরোদমেই চলছে। গার্মেন্টস, শিল্পকারখানা নিয়মনীতি না মেনেই জমজমাট। হেফাজতের আন্দোলনও কোথাও কোথাও নাকি হয়েছে। রাস্তাঘাট, মসজিদে, বাজারে মানুষ। জনসমাগম সবখানেই হচ্ছে। আগের চেয়ে বাজারে এখন বেশি মানুষ। চা’র দোকানের আড্ডাও বেশ জমছে। পত্রিকায় দেখছি, কর্মহীন মানুষ কোথাও কোথাও খোলা মাঠে জুয়ার আড্ডায়ও মেতেছে। মানুষ যেন আগের চেয়ে বেশ সচল।

কঠোর নিষেধাজ্ঞায় সরকারের ক্ষতি বেশি। দেশের অর্থনীতির চাকা অচল, তা সামাল দিতে সরকারকে হিমশিম খেতে হয়। মানুষের জীবনতো আগে তাই কঠোর নিষেধাজ্ঞায় যেতে হয়েছে সরকারকে। সরকারকে সহায়তা করুন।

আগেও দেখেছি এদেশে হাস্যকর লকডাউন আর কোয়ারেন্টাইন চলে। লকডাউনে মানুষ এক জেলা থেকে আরেক জেলায়ও যাচ্ছে। পঙ্গপালের মতো ট্রাক আর কাভার্ডভ্যানে মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। নিষিদ্ধ গণপরিবহনও রাস্তায় দেখছি। অসচেতনতা আর কাকে বলে? যে দেশে জেল জরিমানা দিয়ে মানুষ বশ করা যায় না, সেখানে স্বেচ্ছায় লকডাউন আর বাসগৃহের কোয়ারেন্টাইনের কথা শুনি। করোনা ভাইরাস নেগেটিভ আর পজিটিভের দৌড়ঝাঁপ মুখের কথায় বন্ধ করা অন্তত এদেশে অসম্ভব।

কঠোর নিষেধাজ্ঞায় ঢাকা শহরেতো ফাঁকা থাকার কথা। এখনও যানজট চোখে পড়ছে। রাস্তাঘাটে অসংখ্য মানুষ। অনেক হোটেল-রেস্তোরাঁ খোলা। সুপার মার্কেটগুলোও কিছু খুলেছে। তবে শপিংমলগুলো বন্ধ। নতুন করে করোনার ঢেউ শুরু হওয়ায় সারাবিশ্ব যেখানে সতর্ক সেখানে আমাদের দেশে সবকিছু অনেকটা স্বাভাবিক। পরে হয়তো বুঝতে পারবো কতটা ক্ষতি হলো।

করোনায় করুণা করছে না কাউকে। সবচেয়ে ধনী দেশগুলো করোনায় কুপোকাত। উন্নত প্রযুক্তি, গবেষণা, করোনা ভ্যাক্সিন, কোনোটাই কাজে আসছে না। মানুষ মরছে প্রতিদিন। আমাদের আরও প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা কতটা প্রস্তুত? আর কতটা সতর্ক? সতর্কতা খুবই কম। মানুষ কথা শুনতেই চায় না। সরকারের নিয়মের তোয়াক্কা করে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে না। তাতে অনেক ভয়ংকর রূপে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। তাতে সামাল দেওয়া কঠিনই হবে। এখনই তা হচ্ছে।

নতুন করে করোনার ঢেউ শুরু হওয়ায় সারাবিশ্ব যেখানে সতর্ক সেখানে আমাদের দেশে সবকিছু অনেকটা স্বাভাবিক। পরে হয়তো বুঝতে পারবো কতটা ক্ষতি হলো।

সতর্কতার অভাবে করোনাভাইরাসে সারাদেশে মানুষ এমনকি বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অনেক ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। দিনদিন বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা। অরক্ষিত অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে এঅবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

হয়তো সামনে সুসংবাদ নেই। ভয়াবহ দিন আসছে। আক্রান্ত এবং মৃত্যুর মিছিলে অসংখ্য মানুষ যুক্ত হচ্ছে। এসময় চিকিৎসকদেরই সবচেয়ে দরকার। চিকিৎসকরা যাতে সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত না হয় সে ব্যাপারে সরকার সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি দিতে হবে। তাদের নিরাপদ রাখা খুব জরুরি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ না করায় এবং মন্ত্রণালয়ের নানা গাফিলতির কারণে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় বাজে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আক্রান্তদের সেবা দেওয়া যাচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রে। হাসপাতালে সাধারণ সিটও নেই। আইসিইউতো সোনার হরিণ।

যেভাবেই বলি, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের যুদ্ধে নামতে হবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে হবে।

করোনা পজিটিভ উপসর্গ হলেই ভয়ে মুষড়ে যাবেন না। করোনা পজিটিভ মানেই মৃত্যু নয়। আপনি নিয়মকানুন মেনে চললে ঠিকই সেরে উঠবেন। মনে রাখবেন, ভাইরাস থেকে রক্ষার একটাই পথ, সতর্কতা।

মীর আব্দুল আলীম ।। সাংবাদিক ও কলামিস্ট