২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে ৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণ করে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।

এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর এই সরকারের কাজকর্ম মূল্যায়নের সময় এসেছে, বিশেষ করে যখন অন্তর্বর্তী সরকার সাম্প্রতিক ঘোষণায় ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেছে এবং জুলাই সনদ প্রণয়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জনগণের এক রক্তাক্ত প্রত্যয়ে—স্বৈরশাসনের অবসান, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভাঙা, রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কার এবং একটি গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা নির্মাণের অঙ্গীকারে। বাস্তবতা হলো, এক বছরের মাথায় সেই প্রত্যাশাগুলোর কতটা পূরণ হয়েছে, তা নিয়ে একগুচ্ছ প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

প্রথমত, শহীদ ও আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ ছিল অপর্যাপ্ত, প্রতীকী বললেও বেশি বলা হবে না। শহীদদের তালিকা প্রকাশিত হলেও তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে; আহতদের চিকিৎসায় অব্যবস্থাপনা, অবহেলা এবং আন্দোলনের চাপে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অথচ এই মানুষগুলোই ছিলেন পরিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তি।

দ্বিতীয়ত, কাঠামোগত সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকার বেশকিছু কমিশন ও টাস্কফোর্স গঠন করলেও বাস্তবায়নের অগ্রগতি অত্যন্ত সীমিত। সাংবিধানিক সংস্কার, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, পুলিশ সংস্কারসহ কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আংশিক ঐকমত্য সৃষ্টি হলেও তা বাস্তবায়নের কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই। এর বিপরীতে আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের প্রবণতা থেকে সরকার নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি—বরং পুরোনো সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।

বিদ্যমান গুম সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সচেতনতা বেড়েছে, জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে, সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা তীব্র হয়েছে...

সম্ভবত অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে দুর্বল দিক হচ্ছে এর প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে বেসামরিক আমলাতন্ত্র পরিচালনায়। ন্যূনতম শৃঙ্খলা, যা একটি কার্যকর রাষ্ট্র পরিচালনার পূর্বশর্ত, তা আজ মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েছে। প্রশাসনে অকারণ এবং ব্যাপক হারে বদলি, যেখানে মেধা বা যোগ্যতার চেয়ে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে, তা প্রশাসনিক ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতাকে বিপর্যস্ত করেছে।

এনসিপি-ঘনিষ্ঠদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোকে ঘিরে যে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে, তা আমলাতন্ত্রের পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি করেছে।

নতুন বেতন কাঠামোর ঘোষণা এবং নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণির জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদানের পদক্ষেপগুলো অনেকের কাছে জনপ্রিয় মনে হলেও, এগুলো একটি সুপরিকল্পিত প্রশাসনিক সংস্কারের অংশ হিসেবে নয় বরং পুরোনো আমলা-তোষণ সংস্কৃতির হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এই ধরনের পদক্ষেপ অন্তর্বর্তী সরকারের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং এর ন্যায্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

একইভাবে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে সরকারের উদ্যোগ ছিল সীমিত এবং অনেকাংশে প্রতীকী।

আদালত পাড়ায় রাজনৈতিক দল সমর্থিত আইনজীবী এবং বিচারিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নতুন এক ব্যবস্থা গড়ে ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিচারব্যবস্থাকে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকে মুক্ত করা বা আদালতের জবাবদিহিতা জোরদার করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়নি।

আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে, তার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর, স্বচ্ছ এবং দৃশ্যমান পদক্ষেপ এখনো নেওয়া হয়নি। ফলে, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক মহলে এটি একটি নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে যে, দায়মুক্তির সংস্কৃতি হয়তো এই সরকারেও বজায় থাকবে।

এই সব প্রশাসনিক শৈথিল্য, বিচারিক সংস্কারে অগ্রগতির অভাব এবং মানবাধিকার রক্ষায় উদাসীনতা একত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা নিয়ে গভীর সংশয় সৃষ্টি করেছে।

অর্থনৈতিক পরিসরে কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও, যেমন মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ, রিজার্ভে স্থিতিশীলতা—তবু তা ছিল অনেকটা বৈশ্বিক মন্দা ও চাহিদা হ্রাসের স্বাভাবিক ফলাফল। মূলধারার সংস্কার, যেমন পরোক্ষ কর নির্ভর বাজেট কাঠামো পরিবর্তন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণ রোধ—এসব বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
শ্রমজীবী মানুষের দাবি যেমন জাতীয় ন্যূনতম মজুরি, বাস্তব মজুরি বৃদ্ধি, নিরাপদ শ্রম পরিবেশ—এসব বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার উদাসীন থেকেছে। একমাত্র পোশাক শ্রমিকদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো হলেও তা মূল্যস্ফীতির তুলনায় ছিল অপ্রতুল।

অন্য শ্রমিক শ্রেণি, যেমন গৃহকর্মী, নির্মাণ শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক বা তামাক শ্রমিকদের জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কৃষক শ্রেণিও অবহেলিত থেকেছে—সার, বীজ, পানি, ও ন্যায্য মূল্যের দাবিগুলো বারবার উঠলেও সাড়া আসেনি।

পররাষ্ট্রনীতি এবং জাতীয় সম্পদের ব্যবস্থাপনায়ও অন্তর্বর্তী সরকার অনেকাংশে আগের সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। রামপাল, রূপপুর, আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিতর্কিত চুক্তিগুলোর পুনর্মূল্যায়ন হয়নি, চট্টগ্রাম বন্দর ইজারা বিষয়েও স্বচ্ছতা অনুপস্থিত।

এই মুহূর্তে আশাব্যঞ্জক দিক হলো, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেছে এবং একটি 'গণ-অভ্যুত্থান ঘোষণাপত্র' প্রকাশ করেছে, যা আগামী দিনের শাসনব্যবস্থার জন্য একটি নৈতিক ভিত্তি ও রূপরেখা হিসেবে কাজ করতে পারে।

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও মৌলবাদী সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা ছিল রীতিমতো দুর্বল। সংখ্যালঘু, নারীবান্ধব ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর ধারাবাহিক হামলা চালানো হলেও তা রোধে সরকারকে সক্রিয় দেখা যায়নি। বরং বহুক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নীরবতা অবলম্বন করা হয়েছে, যা উদ্বেগজনক।

অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের অনেকেই রাষ্ট্রক্ষমতার বিভিন্ন স্তরে জায়গা করে নিয়েছেন। কিন্তু তাদের অনেকে ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে ঢুকে পূর্বের ব্যবস্থার অংশ হয়ে গেছেন বলে জনগণের মধ্যে এক ধরনের ‘চেতনা ব্যবসা’র ধারণা তৈরি হয়েছে। জাতীয় ন্যূনতম মজুরি, কর কাঠামো সংস্কার, শহর-গ্রামের বৈষম্য দূরীকরণ—এসব বিষয়ে তাদের কাছ থেকে কার্যকর উদ্যোগ প্রত্যাশা করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।

তবে কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। যেমন বিদ্যমান গুম সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সচেতনতা বেড়েছে, জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে, সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা তীব্র হয়েছে এবং একচেটিয়া ক্ষমতার বিপক্ষে জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের ধারণা গভীর হয়েছে। এই অর্জনগুলো ভবিষ্যতের জন্য প্রেরণা হয়ে থাকতে পারে। অন্তত এমন একটি বাস্তবতা তৈরি হয়েছে যেখানে কেউ আর সহজে একনায়কতন্ত্র চাপিয়ে দিতে পারবে না।

এই মুহূর্তে আশাব্যঞ্জক দিক হলো, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেছে এবং একটি 'গণ-অভ্যুত্থান ঘোষণাপত্র' প্রকাশ করেছে, যা আগামী দিনের শাসনব্যবস্থার জন্য একটি নৈতিক ভিত্তি ও রূপরেখা হিসেবে কাজ করতে পারে। কিন্তু এই ঘোষণাপত্রে দেশের প্রান্তিক মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্য, কৃষক ও শ্রমিকের অধিকার, নারীর নিরাপত্তা ও শিক্ষা-স্বাস্থ্যের প্রশ্নগুলো কেন্দ্রীয় জায়গা পাবে কি না, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। দুঃখজনক হলো এই ঘোষণাপত্রে ইতিহাসের একটি পূর্ণাঙ্গ এবং বস্তুনিষ্ঠ বয়ান দেওয়া হয়নি বলে দাবি করা যায়।

শেষ কথা, ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান ছিল এক অনিবার্য ক্ষোভের বিস্ফোরণ, এক বৈপ্লবিক প্রত্যাশার উৎসারণ। কিন্তু এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নির্মিত অন্তর্বর্তী সরকার সেই আকাঙ্ক্ষার পুরো প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনি। ইতিহাস এই সরকারকে হয়তো একটি ‘অবকাশকালীন ব্যবস্থাপনা’ হিসেবে চিহ্নিত করবে, কিন্তু তারা যদি এই সময়কে জনগণের আকাঙ্ক্ষার দিকে ঠেলে দিতে পারে, তবে তারও একটি আলাদা গুরুত্ব থেকে যাবে।

ড. কাজী মারুফুল ইসলাম : অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়